লাশ নিয়ে রাজনীতি, লাশের পরিচয় নিয়ে রাজনীতি আমাদের দেশে নতুন নয়। আসলে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করলেও রাজনীতিকে এখনো অ্যানালগ বা অতীতের ধারায় রেখে দিয়েছি। রাস্তা দখল, লাশ ফেলে দেওয়া, লাশ নিয়ে মিছিল করা—এগুলো যেমন পাকিস্তান আমলে ছিল, তেমনি বাংলাদেশ আমলেও আছে। অবশ্য শুধু আমাদের দেশ কেন, প্রতিবেশী বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতেও কি কাড়াকাড়ি ও মারামারির রাজনীতি কম চলছে? মানুষকে পক্ষে আনার জন্য আগে তবু রাজনৈতিক দলের নেতারা মানুষের কাছে যাওয়ার গরজ বোধ করতেন। সভা-সমাবেশের আয়োজন করে নিজ দলের কর্মসূচি মানুষের সামনে ব্যাখ্যা করতেন, অন্যদের চেয়ে তাঁরা কোথায় কোথায় আলাদা, তা বুঝিয়ে মানুষকে পক্ষে টানার চেষ্টা করতেন। এখন আর বুঝিয়ে পক্ষে আনার চেষ্টা নেই, এখনকার রাজনীতি হলো ‘ধর তক্তা মার পেরেক’। চলছে ভয় দেখিয়ে জয় করার খেলা। মানুষের বড় সমাবেশ ঘটিয়ে শক্তি প্রদর্শন না করে বোমা ফাটিয়ে শক্তি দেখানো হয়।
কয়েক দিন ধরে দেশের রাজনীতির মাঠ হঠাৎ গরম হয়ে ওঠার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সরকারকে, অর্থাৎ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি। বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু এই আবদার সরকার কেন রাখবে? ক্ষমতাসীন সরকার পদত্যাগ করে কোন গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়? ৯০ দিন অনির্বাচিত ব্যক্তিরা ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন, এটা কেমন গণতন্ত্র! অনির্বাচিতরা নির্বাচন পরিচালনা করলে সেটা সহি নির্বাচন হবে বলে আমাদের নাগরিক সমাজের যাঁরা হইচই করছেন, তাঁরা কার্যত রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করার জন্য উদ্ভট সমাধানের পক্ষেই ওকালতি করছেন নাকি? একদিকে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দাবি তোলা হবে, অন্যদিকে অনির্বাচিত কোনো শক্তি ক্ষমতা দখল করলে তারও নিন্দা জানানো হবে। এই স্ববিরোধিতাই কি আমাদের রাজনীতির গোড়ায় গলদ নয়?
আমি এটা মনে করি যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দুর্বল হয় আর বিএনপি দুর্বল হয় বিরোধী দলে থাকলে। আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকেই হয়তো একমত হবেন না, তা হওয়ার দরকারও নেই। তবে লক্ষ করলে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? বিএনপি সেই ২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতার বাইরে আছে। টানা এত বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপি কি দুর্বল হয়নি? বিএনপি দুর্বল হয়েছে রাজনৈতিকভাবে এবং সাংগঠনিকভাবেও। আর সে জন্যই বারবার সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটানোর কথা বললেও বাস্তবে মাঠের দখল নিতে পারে না। তাদের শক্তিমত্তা নিয়ে সরকার ও সরকারি দল ঠাট্টা-মশকরা করতে দ্বিধা করে না।
আবার আওয়ামী লীগ যে টানা এত বছর ক্ষমতায় আছে, তাতে কি দলটির সাংগঠনিক শক্তি সংহত হয়েছে, নাকি ক্ষমতায় থাকায় দলটি সরকারের পেটে ঢুকে পড়েছে? আওয়ামী লীগের সরকার এখন পরিণত হয়েছে সরকারের আওয়ামী লীগে। সরকার পরিচালনায় আমলানির্ভরতা রাজনৈতিক দলের শক্তির পরিচয় বহন করে না।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে গেলেও বাধা না দিয়ে চা খাওয়াবেন বলে গণমাধ্যমে খবর ছাপা হওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, এবার বুঝি রাজনীতিতে সুবাতাস বইবে। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? গত দুই সপ্তাহে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কমপক্ষে ২০টি স্থানে বিএনপির মিছিল-সমাবেশ হয় পুলিশ, না হয় আওয়ামী লীগ ঘরানার কোনো না কোনো সংগঠনের হামলার শিকার হয়েছে। শুধু মিছিল-সমাবেশে বাধা দেওয়া নয়, বিএনপি নেতাদের অফিস-বাসায় আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা হামলা চালিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে।
এর মধ্যে ভোলা এবং নারায়ণগঞ্জে বিএনপির তিনজন নিহতও হয়েছেন। ভোলায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিচয় নিয়ে বিতর্ক না হলেও নারায়ণগঞ্জে নিহত শাওনের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে টানাটানি হচ্ছে। শাওন আওয়ামী লীগের সমর্থক না বিএনপির, সেটা নিয়ে বিতর্কের চেয়ে জরুরি হলো, তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা। যেহেতু দুই দলই শাওনকে নিজেদের বলে দাবি করছে, সেহেতু তাঁর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিও নিশ্চয়ই দুই দলই করবে। এ ক্ষেত্রে অন্তত দুই দলের ঐক্য হওয়ার সুযোগ আছে। দেখা যাক, শাওনের রাজনৈতিক পরিচয় শেষ পর্যন্ত কোন দলের পক্ষে যায়!
প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না বলার পর এই সব হামলা-আক্রমণের ঘটনা কেন ঘটছে? বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই, বিএনপি দুর্বল বা শেষ হয়ে গেছে–এসব কথা তো মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই বলেন। সরকার নিশ্চয়ই বিরোধী দলের চেয়ে শক্তিমান এবং সক্ষম। সে জন্যই বিএনপির ওপর সরকারি দলের হামলাকে দুর্বলের প্রতি সবলের আক্রমণ হিসেবেই মানুষ দেখবে। আর সাধারণত দুর্বলের প্রতি মানুষের সমর্থন-সহানুভূতি থাকে বেশি। বিএনপির প্রতি নতুন উদ্যমে সরকার ও সরকার-সমর্থকদের চড়াও হওয়ার ঘটনায় কেউ কেউ এই প্রশ্নও তুলছেন যে সরকার কি তাহলে ভয় পেয়েছে? অথবা আগামী নির্বাচন থেকে বিএনপিকে দূরে রাখার জন্য এই চোখরাঙানি কি না?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘আমি তো আন্দোলন করার কথা বলছি। আমি তো বলেছি মিছিল করেন, মিটিং করেন শান্তিপূর্ণ। কেউ কিচ্ছু বলবে না। যেখানে শান্তিপূর্ণ হচ্ছে, সেখানে তো কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু এরা তো মাঠে নেমেই আগে কোথায়, কাকে আক্রমণ করবে, কীভাবে একটা অবস্থা তৈরি করবে, এটা করার একটা কারণ আছে, এমনি মিছিল হলে তো মিডিয়াতে কভারেজ পাবে না। মিডিয়াতে কভারেজ বাড়ানোর জন্যই তারা এমন একটা ঘটনা ঘটাবে, তারা যেন একটু...পায়।’
বিএনপি এবং মিডিয়াকে একসঙ্গে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে প্রধানমন্ত্রী এরপর বলেছেন, ‘আমি বলেছি পুলিশকে কিছু না বলার জন্য। এটা ঠিক। কিন্তু পুলিশ তো আগ বাড়িয়ে কিছু করেনি।... ওনাদের কথায় মনে হয়, তারা বোম ছুড়বে, লাঠি মারবে, ঢিল মারবে, গুলি করবে, সব করবে, তাদের কিছু বলা যাবে না।...পুলিশ বাদ দেন, যেকোনো একটা মানুষ যদি আক্রান্ত হয়, তার নিজেকে বাঁচাবার অধিকার আছে। সেটা কি নাই? নাকি পুলিশ হলে, তারা আক্রান্ত হলে, নিজেকে রক্ষা করবার কোনো অধিকার থাকবে না?’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা মনে হচ্ছে, পুলিশ যে বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিচ্ছে না, তার জন্য দায়ী বিএনপি। বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ কিংবা আন্দোলন করতে পারে না বলেই পুলিশকে লাঠি বা গুলির প্রয়োগ ঘটাতে হয়। আমরা যদি এটা ধরেও নিই যে বিএনপি পুলিশের ওপর আগ বাড়িয়ে ঢিল ছোড়ে বলেই পুলিশ পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হয় বলে একটি কথা চালু আছে। কিন্তু ঢিলের বদলে গুলি কেন? বলা হতে পারে, পুলিশের হাতে ঢিল বা পাটকেল থাকে না, থাকে বন্দুক ও গুলি। তাই বিএনপির মিছিল-সমাবেশ থেকে ঢিল ছুড়লে পুলিশকে গুলিই ছুড়তে হয়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা রাস্তায় নামেন কেন? বিএনপির মিছিল-সমাবেশ যদি শান্তিশৃঙ্খলার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের শান্তি রক্ষার দায়িত্ব কে দিয়েছে–সে প্রশ্ন করাই যায়।
বিএনপির যেমন আন্দোলন-সমাবেশ-বিক্ষোভ করার অধিকার আছে, তেমনি সরকারেরও দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের জানমালের হেফাজত করা। আন্দোলনের নামে সহিংসতা করার অধিকার কারও নেই। অধিকারের সঙ্গে দায়িত্বের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। এখন সমস্যা হচ্ছে, বিরোধী দল যখন অধিকার প্রয়োগের কথা বলে, তখন দায়িত্বশীলতার কথা ভুলে যায়। আবার সরকার যখন দায়িত্ব পালনের কথা বলে, তখন অধিকারের কথা মনে রাখে না।
আমাদের দেশের রাজনীতির এই এক গভীর সংকট। একপেশে মনোভাব নিয়ে চলা। সরকারে থাকলে এক রকম কথা বা কৌশল, বিরোধী দলে থাকলে ভিন্ন কথা, ভিন্ন কৌশল। এখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ, তাই তারা মানুষের জানমালের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। আবার বিএনপি এখন বিরোধী দলে, তারা ভুলে গেছে ক্ষমতায় থাকতে বিরোধী দলের অধিকার সম্পর্কে তাদের অবস্থান কেমন ছিল। ‘আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও’ বলে যে কথাটি বহুকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তা মনে রাখে না।
নারায়ণগঞ্জে ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশে বাধা দেওয়ার কারণ সম্পর্কে পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেছেন, ‘বিএনপি বিনা অনুমতিতে রাস্তা আটকে রেখে মিছিল-সমাবেশ করছিল।’ এখানেও দুটি প্রশ্ন আছে। প্রথম প্রশ্ন, সভা-সমাবেশ করা নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। কাজেই সভা-সমাবেশ করতে অনুমতি লাগবে কেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, এই যে সভা-সমাবেশ করার জন্য পূর্ব অনুমতির বিষয়টি কি আওয়ামী লীগ চালু করেছে? নাকি আগে থেকেই ছিল? বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন এই মৌলিক অধিকারবিরোধী বিধানটি বাতিল করেনি কেন? নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে যে নিয়মের চর্চা করেছে, আওয়ামী লীগও তা-ই করছে? কেউ বলতে পারেন, আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির জুতো পায়ে দিয়ে পথ চলবে? তখন আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা বলবেন, বিএনপির খারাপটা মানুষ সহ্য করলে আওয়ামী লীগেরটা অসহ্য লাগে কেন?
এসব বিতর্কের আসলে শেষ নেই। কার কথা মনে নেই, কিন্তু কথাটি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করে উদ্ধৃত করছি। কথাটি হলো ‘জ্ঞানী ভুল করলে অনুতপ্ত হয় আর নির্বোধ ভুল করলে ভুলের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়।’
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা