দুঃসংবাদ নিয়ে এল ১৯৯৬ সাল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বোন ক্যানসার। ২৬ জানুয়ারি চিকিৎসার জন্য কলকাতায় গেলেন তিনি সস্ত্রীক। কলকাতার বন্ধুদের মধ্যেও তখন বিষাদ। বলিষ্ঠ মানুষটাকে হুইলচেয়ারে দেখে কারই-বা ভালো লাগবে?
তীব্র ব্যথার জন্য সম্বল পেইন কিলার। চিকিৎসা শুরু হলে গেস্টহাউস থেকে তাঁকে সরিয়ে নেওয়া হলো সেলিমপুরের একটি নার্সিং হোমে। একটা সুইট মতো। যাঁরা তাঁকে দেখতে যান, তাঁরা চেষ্টা করেন ভালো চা, পনির, মিষ্টি নিয়ে যেতে। ইলিয়াস তাতে বিব্রত হন। শেষে লিখে ফেলেন ছড়া—
আমার এমন বিদঘুটে এক রোগ
সকাল বিকাল দেখতে আসে লোক
হাতে পেঁপে কমলালেবু, ডাব
চোখে তাদের দুঃখ, দুঃখ ভাব।
একবার এল গোলাপজাম। সেগুলো খাওয়া হলো কাড়াকাড়ি করে। বেশিটাই খেলেন ইলিয়াস। বললেন, ‘আমি গ্রামের ছেলে তো, এসব ফলের কথা আমিই জানি। আমার নাকের ওষুধের গন্ধ ঝেঁটিয়ে এই গোলাপজামের সুগন্ধ আমাকে আরাম দিচ্ছে।’
একদিন মিহির সেনগুপ্তকে ইলিয়াস বললেন, ‘শুধু তানপুরা দিয়ে ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রসংগীত শোনাতে পারো?’
মিহির গেলেন তাঁর বন্ধু শঙ্করের কাছে। তিরিশ বছর বয়সে সুবিনয় রায়ের কাছে গান শেখা শুরু করেছিলেন শঙ্কর। কিন্তু গানে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য ক্যাসেট করেননি। তাঁকে ধরলেন মিহির। বললেন, ‘একটা ক্যাসেট নিয়ে আসি। গান করে দাও।’
মিহির রাজি হলেন। ৯০ মিলিমিটারের ক্যাসেটে তানপুরাসহ গান তৈরি হলো সেদিনই। সে গান এল ইলিয়াসের কাছে। ইলিয়াস বললেন, ‘আমি যদি একটু বেশি রাত জেগে গান শুনি, তাতে পাশের ঘরের কেউ আপত্তি করবে না তো?’
ব্যথায় কাতরানোর শব্দের চেয়ে গানের সুর অন্যদের প্রশান্তি দেবে, বোঝানো হলো ইলিয়াসকে।
ক্যাসেটে প্রথম গানটি ছিল ‘তোমায় যতনে রাখিব হে, রাখিব কাছে...’।
গানটি শুনতে শুনতে ইলিয়াসের দুই চোখে বইতে লাগল জলের ধারা।
সূত্র: মিহির সেনগুপ্ত, অন্তরঙ্গ ইলিয়াস, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৮