আহ! কী যে সুখ! রাজনৈতিক জীবনে এর চেয়ে সুখের কী আছে? একটা এলাকা, যেখানে নামমাত্র নির্বাচন হয়। একজনকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে বলা হয়, ‘বেছে নাও!’ সবাই তাঁকে বেছে নেয়।
রাউজান একটা অসাধারণ এলাকা। ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা কিংবা উপজেলা নির্বাচনের জন্য সেখানে এখন আর প্রতিযোগিতা হয় না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়, দেখা যায় মনোনয়নের জন্য প্রতি পদে মাত্র একজনই প্রার্থী! ফলে নির্বাচনের আর দরকার হয় না। মনোনয়নপত্র দাখিল করা ব্যক্তিকে যে কেউ নির্বাচিত সদস্য বলে ধরে নিতে পারেন। তিনি ছাড়া প্রার্থী নেই, কিন্তু নির্বাচন তো আছে। হোক না তা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়!
রাউজান উপজেলার কথা মনে হলে একাত্তরের কয়েকটি দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল এই উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের উনসত্তরপাড়া গ্রামে পাকিস্তানিরা ব্যাপক লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যা করেছিল ৪৮ জন নিরীহ মানুষকে। রাউজানের কথা মনে হলেই মনে পড়ে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ নূতন চন্দ্র সিংহের কথা। নিজ প্রতিষ্ঠানের সামনেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে এ রকম আরও অনেক নজির আছে, যা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, রাউজান জানিয়ে দিচ্ছে, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়।’
অথচ সেই রাউজানে নির্বাচন হচ্ছে না! সেই রাউজানে এক এক পদে মাত্র একটা করে মনোনয়নপত্র জমা পড়ছে। ক্ষমতাসীন দল ছাড়া আর কেউ সেখানে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন না। বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি অনীহা থেকে বিরোধীরা নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছে না, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে, সেটা যে কেউ বুঝতে পারেন। কিন্তু বুঝেও কেন তাঁরা এর প্রতিবাদ করেন না, সেটাও হয়তো একটু একটু বোঝা যায় এবং অবাক করা ব্যাপার, বিভিন্ন এলাকায় বিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করলেও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সদস্য দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন নির্বাচনে। জোর নির্বাচনী লড়াই হচ্ছে। বিদ্রোহী প্রার্থী কোথাও কোথাও ছিনিয়ে নিচ্ছেন আসন। কিন্তু রাউজান কীভাবে একেবারে ব্যতিক্রমী একটা এলাকা হয়ে উঠল, সেটাই রহস্য!
রাউজানে পরিকল্পিতভাবে কিছু মানুষ নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন এবং তাঁদেরই ভোট দিতে হচ্ছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে ভোটে জনগণের অংশগ্রহণের কোনো মানে থাকে না। আমাদের ব্যালট পেপারে নেতিবাচক ভোট দেওয়ার রেওয়াজ থাকলে হয়তো-বা বোঝা যেত, জনগণ এই একক প্রার্থীকে কতটা পছন্দ করে!
রাউজানের এই এককেন্দ্রিক নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য মোটেই সুফল বয়ে আনবে না। এর পেছনে যে পেশিশক্তির একটা সংযোগ আছে, তা অনুমান করা যায়। আর এ ক্ষেত্রে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ প্রবাদবাক্যটি একেবারে খাপে খাপে মিলে যায়। এই প্রবণতা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে আখেরে খুব একটা সাহায্য করবে না। এই প্রক্রিয়া থেকে রাউজান যেন বেরিয়ে আসে, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের।