সরকারের যদি নির্বাচন কমিশন আইন করার এখতিয়ার না থাকে তাহলে আইনের কথা বিএনপি তুলেছিল কেন? এই সংসদ নির্বাচিত নয়, অথচ বিএনপির কয়েকজন সদস্য সংসদের কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন, বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। একটি আইনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনের কথা সংবিধানে থাকলেও গত ৫০ বছরে সরকার এসেছে, সরকার গেছে কিন্তু আইনটি হয়নি। এ নিয়ে অনেকের মনে কষ্ট, ক্ষোভ, মনোবেদনা ছিল। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে আইন করার দাবি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে তোলা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, এত অল্প সময়ে আইনটি করা সম্ভব হবে না। তখন আইনের পক্ষে যাঁরা তাঁদের কেউ কেউ বলেছিলেন, আইন করতে বেশি সময় লাগবে না। এমনকি অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারি করেও এই আইন করা যায়।
এর মধ্যে হঠাৎ করেই সরকারের মত পরিবর্তন হয়। ইসি নিয়োগের আইনের খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়ে সংসদে উত্থাপিত হয় এবং কিছু পদ্ধতি অনুসরণের পর ২৭ জানুয়ারি সংসদে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল’ পাস হয়েছে। বিএনপিসহ অন্য সরকারবিরোধী দলের পক্ষ থেকে তাড়াহুড়ো করে এই বিল পাসের সমালোচনা করা হয়েছে। বিএনপির সাংসদেরা বলেছেন, ইসি আইনের মাধ্যমে কার্যত সরকারের ‘নির্বাচনবিষয়ক মন্ত্রণালয়’ হতে যাচ্ছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ইসি আইন পাসে কোনো তাড়াহুড়ো হয়নি। এই আইনের কারণে আন্দোলন শুরুর চেষ্টার ‘মসলা’ আর থাকেনি। সে জন্যই এখন অনেকে এর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার অনেক দিন আগে থেকেই এটা প্রস্তুত করে রেখেছিল। এই বিল পাসের মাধ্যমে জনগণের ভোট সুরক্ষিত হলো। গণতন্ত্র আরও শক্তিশালী হলো।
বিরোধীরা যখন দাবি উত্থাপন করে, তখন দেরি না করে তা তাড়াতাড়ি মানতে বলা হয়। সরকার কোনো পদক্ষেপ নিলে বলা হয়, এত তাড়াহুড়া কেন? এ এক বড় জটিল অবস্থা। যা চাওয়া হয়, তা কি ভুল করে চাওয়া হয়? নাকি যা পাওয়া যায় তা চাওয়া হয় না? এত দিন সমস্যা ছিল নির্বাচন কমিশন গঠনের আইন না থাকা। এখন আইন হওয়ার পর বলা হচ্ছে, এভাবে সরকারের চাপিয়ে দেওয়া আইন চাই না। তাহলে কেমন আইন চাই, তার একটি রূপরেখা বা প্রস্তাব কি আগেই দেওয়া উচিত ছিল না? হাতের কাছে একটি বিকল্প প্রস্তাব থাকলে পাস হওয়া আইনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যেত, কী চেয়ে কী পেলাম।
সবার সঙ্গে কথা বলে, অংশীজনের পরামর্শ নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আইন করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু একমত হয়ে আইন তৈরির বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশে আছে কি? রাজনৈতিকভাবে আমাদের সমাজ বিভক্ত। আমাদের রাজনীতিতে বিভেদ বেশি, ঐক্য কম। গলাগলির চেয়ে আমাদের অনেকের দলাদলি বেশি পছন্দ। দুজন মানুষ কোনো বিষয়ে একমত হতে পারে না। পরস্পরবিরোধী ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একমত হতে পারলে দেশের রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরে আসত বহু আগেই। তাই আওয়ামী লীগের তৈরি আইন বিএনপির কাছে ফাঁদ মনে হবে। আবার বিএনপির প্রস্তাবকে আওয়ামী লীগ ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ বলেই মনে করবে।
২০২৩ সালের শেষের দিকে দেশে একটি সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। এই সময়ের মধ্যে সরকার পরিবর্তনের কোনো আশঙ্কা বা সম্ভাবনা কোনো রাজনৈতিক জ্যোতিষী দেখছেন বলে মনে হয় না। বিএনপি কি সত্যি বিশ্বাস করে, এই সময়ে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন ঘটিয়ে তাদের পছন্দের সরকারের অধীনে নির্বাচন করে সরকার গঠন করতে পারবে?
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আওয়ামী লীগের শক্ত প্রতিপক্ষ বিএনপি। এখন আওয়ামী লীগ সরকারকে মোকাবিলার জন্য বিএনপি কি কৌশলে এগোতে চাইছে, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। এমনকি বিএনপির নেতা-কর্মীরাও সবাই জানেন না, তাঁদের দলের আসল পরিকল্পনা এবং কর্মকৌশল কী?
এ অবস্থায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এক বক্তৃতা থেকে রাজনৈতিক মহলে কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি করবে বলে মনে হয়। বিএনপির মহাসচিব বলেছেন, বাকশাল করে আওয়ামী লীগের শেষরক্ষা হয়নি। নির্বাচন কমিশন আইন করেও দলটির শেষরক্ষা হবে না। বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সেদিনও বাকশাল করেছিল নিজেদের বাঁচানোর আশায়। আজকেও তারা একটা নির্বাচন কমিশন আইন তৈরি করল। তারা ভাবছে তারা বেঁচে যাবে এই আইনটা পাস করে। কিন্তু তারা ভুলে গেল বাকশাল করেও শেষরক্ষা হয়নি। ঠিক একইভাবে এই আইন করেও তাদের শেষরক্ষা হবে না।’
আওয়ামী লীগের ‘শেষরক্ষা হবে না’ বলতে মির্জা ফখরুল আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন? আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকতে পারবে না? আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানো হবে? কীভাবে? সরকার পতনের গণতান্ত্রিক উপায় হলো নির্বাচন। অথচ বিএনপি বলছে, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। তাহলে কি গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হবে?
কোনো দল বা নেতা চাইলে কিংবা নির্দেশ দিলেই কোনো দেশে গণ-অভ্যুত্থান হয় না। তা ছাড়া ২০০৬ সাল থেকে বিএনপি ও তার মিত্ররা ক্ষমতার বাইরে আছে। ক্ষমতায় থেকে যে দলটি গঠিত হয়েছিল, সেই দলটির এত দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু বিএনপি টিকে আছে। অবশ্য দলটির সাংগঠনিক কাঠামো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপসহীন নেত্রীর ইমেজ এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তিনি এখন দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত। তিনি নানা রোগে আক্রান্ত। সরকারের অনুকম্পায় জেলের বাইরে থেকে পছন্দসই হাসপাতালে নিজের বাছাই করা চিকিৎসকদের অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁকে কারামুক্ত করে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতে সরকার সাড়া দেয়নি। এ নিয়ে আন্দোলনও গতি পায়নি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে লন্ডনে সপরিবারে পলাতক জীবনযাপন করছেন।
বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি যখন মজবুত ছিল, খালেদা জিয়া সুস্থ ও রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন, তখন আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার হটানোর ডাক বহুবার দেওয়া হলেও তা হয়নি। সন্ত্রাস-সহিংসতা অনেক হলেও গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। সরকারের পতন হয়নি। আগে হয়নি বলে এবারও হবে না, তা অবশ্যই নয়। তবে দেশের মধ্যে একটা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় শুধু কিছু অন্ধ সমর্থক-স্তাবক, যাঁরা আবার কোনো ঝুঁকি নিতে অনাগ্রহী, তাঁদের ওপর ভর করে সরকার পতনের আন্দোলনে কামিয়াব হতে পারবে কি বিএনপি?
এরপর সরকার হটানোর একটা উপায় বাকি থাকে আর সেটা হলো হত্যা কিংবা সন্ত্রাসের পথ। বিএনপি মহাসচিব বাকশালের কথা বলেছেন। বাকশাল করে আওয়ামী লীগের শেষরক্ষা হয়নি। ঠিকই। কিন্তু কীভাবে আওয়ামী লীগের শাসন অবসান হয়েছিল? বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনার মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিয়োগান্ত বিদায় ঘটেছিল। এবারও কি তাহলে বিএনপি তেমন কোনো পরিকল্পনাই সাজিয়েছে? বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্য থেকে এমন কোনো ইঙ্গিত কি পাওয়া যাচ্ছে না? যদি তা-ই হয়, তবে সেটা তো ভয়াবহ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সংগতিহীন কথাও বলেছেন। বর্তমান সংসদের নির্বাচন কমিশন আইন করার এখতিয়ার নেই—এমন মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এই সংসদ জনগণের দ্বারা কোনো নির্বাচিত সংসদ নয়। সুতরাং এই আইন শুধু আমাদের কাছে নয়, সারা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর যে আইন মানুষ গ্রহণ করে না, এটা কোনো আইনই নয়। সেটাকে কেউ মানবে না। এই হাসিনা সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। আমরা আরেকবার বাকশালে ঢুকতে চাই না। আমরা বলেছি যে অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। পদত্যাগ করে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে।’
সরকারের যদি নির্বাচন কমিশন আইন করার এখতিয়ার না থাকে তাহলে আইনের কথা বিএনপি তুলেছিল কেন? এই সংসদ নির্বাচিত নয়, অথচ বিএনপির কয়েকজন সদস্য সংসদের কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন, বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। এটা কেন? বিএনপির কি সবার আগে রাজনৈতিক অবস্থান ও কৌশল পরিষ্কার করা উচিত নয়?
শেষ করতে চাই সবাইকে এটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাস করতেন—কোনো বাঙালি তাঁর বুকে বুলেট ছুড়বে না। তাই তিনি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীন ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মনে করেন একটি বুলেট সব সময় তাঁর দিকে তাক করা আছে। তা ছাড়া, ১৯৭৫ সাল আর এখনকার জাতীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটও এক নয়। হঠকারী রাজনৈতিক চিন্তা কারও মাথায় না থাকলেই ভালো।
বিভুরঞ্জন সরকার, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা