আমাদের সমাজে প্রায়ই শোনা যায় মাথা কেনাবেচার কথা। কেউ যদি কারও কাছে অতিরিক্ত কোনো কাজ করতে বলেন বা জোরপূর্বক কোনো কিছু করতে বাধ্য করেন, তখন যাঁর ওপরে জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে, তিনি বলে ওঠেন, ‘আমার কি মাথা কিনে নিয়েছেন যে আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য?’ আবার যদি কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কারও কোনো কাজের কন্টাক্ট হয়, তিনি যদি কন্টাক্টের বাইরে আরও কিছু কাজ করতে বলেন, তখন নিগৃহীত ব্যক্তি বলেন, ‘আপনার কাছে আমি মাথা বিক্রি করে দেই নাই।’ সুতরাং মাথা কেনাবেচার অর্থ হলো জোর করে কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু আদায় করা; অর্থাৎ অন্যায্য দাবি করার উদ্দেশ্যকে মাথা কেনাবেচা বলে। কোনো অসহায় ব্যক্তিকে মুশকিলে ফেলে বা কোনো রকম ‘সিস্টেম’ করে, তাঁর কাছ থেকে অতিরিক্ত পাওনা আদায় করাকেও মাথা কেনার পর্যায়ে ধরা হয়।
পৃথিবীর বহু দেশে একসময় দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ক্রীতদাসের কোনোরূপ স্বাধীনতা থাকত না। মনিব যা বলবে, যখন যা ইচ্ছা করতে বলবে, তৎক্ষণাৎ মনিবের সেই কাজ করতে সে বাধ্য। দাসদের কাজের একটু এদিক-সেদিক হলে তার ওপরে অত্যাচার করা হতো। অমানবিক নির্মম অত্যাচার করে অঙ্গহানিও করা হতো। কোনো কোনো সময় মেরেও ফেলা হতো।
মধ্যপ্রাচ্যে এই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ানরা আফ্রিকা থেকে দাস কিনে নিয়ে আসত। তাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার ছাড়া অন্য কোনো কিছুর স্বাধীনতা থাকত না।
কালের প্রভাবে সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। পরবর্তী ধাপে এসেছে অতিরিক্ত শ্রম আদায় করা। কম মজুরি দিয়ে সময়ের অতিরিক্ত শ্রমিকদের দিয়ে বিভিন্নভাবে কাজ করানো হতো। যদিও এই শ্রমিকেরা ক্রীতদাসের মতো ব্যবহৃত হতো না, তবে অতিরিক্ত শ্রম দেওয়ার পরেও যথাযথ শ্রমের মূল্য না পাওয়ার জন্য তারা মানবেতর জীবনযাপন করত। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে শ্রমিক আন্দোলনের ফলে মোটামুটি বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে।
তারপরও শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র কায়েমের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, ন্যায্য পাওনা, ন্যায্য মজুরি না পাওয়ার জন্য অক্টোবর বিপ্লব সাধিত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপ, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে। ১৯৯১ সালের পরে বলতে গেলে এই শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র প্রায় বিলুপ্তির পথে। যদিও সমাজতন্ত্রের নামে তিন-চারটি দেশে এখনো সাম্যবাদী ধারা বিদ্যমান আছে নামমাত্র। ওপরের বিষয় সম্পর্কে যে আলোচনা করলাম, এগুলো ব্যক্তিপর্যায়ের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের মানুষের মেধা ও শ্রমের কেনাবেচার কথা। মোটের ওপর সাদা চোখে দেখলে ব্যক্তি পর্যায়ের মাথা কেনাবেচা বন্ধ হয়েছে।
আমাদের দেশে একসময় খেতমজুরদের সাড়ে তিন কেজি চালের দামের সমপরিমাণ প্রতিদিন তাদের মজুরি হবে—এ নিয়ে খেতমজুর সমিতি আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এখন খেতমজুরেরা সাড়ে তিন কেজি চালের মূল্যমানের বেশি মজুরি পাচ্ছেন।
আমাদের তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের আজ থেকে দশ বছর আগেও তাঁদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারিত ছিল না বা তাঁদের কাজের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল না। এখন মোটামুটি এই নিয়ে তেমন একটা বড় আন্দোলন-সংগ্রাম দেখা যায় না।
চা-শ্রমিকদের ভোটাধিকার ছিল না। চা-বাগানের ম্যানেজারের কথায় ওঠবস করা লাগত। সেটা থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ মিলেছে। এখন আসি আজকের লেখার মূল আলোচনায়। এখন মানুষের মাথা কেনাবেচা না হলেও কোনো কোনো দেশের সব মানুষের মাথা কিনে নিয়েছে বড় কয়েকটি রাষ্ট্র। তারা যখন যা খুশি হুকুম দেয়, ছোট ছোট দেশ সেই সব হুকুম মানতে বাধ্য। এই বড় বড় কয়েকটি দেশ ছোট ছোট দেশের মানুষকে মনে মনে তাদের দাস ভাবে। ছোট দেশগুলোর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানেরা অথবা যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাঁদের ওপরে এমন একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করে রাখে এই মনে করে যে এসব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা তাদের দাস, অর্থাৎ তাঁদের মাথা কিনে নিয়েছে। অন্যভাবে ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, এই ছোট ছোট দেশের মানুষজন সরকার, রাষ্ট্রপ্রধানসহ সবাই তাঁদের মাথা বিক্রি করে দিয়েছেন ওই গুটিকয়েক দেশের কাছে।
কারণ, ওই গুটিকয়েক দেশের কাছে একটি অস্ত্র আছে। সেই অস্ত্রটির নাম ‘স্যাংশন’ বা নিষেধাজ্ঞা। এসব ছোট দেশের মাথার ওপর নিষেধাজ্ঞার খড়্গ সব সময়ই ঝুলিয়ে রাখে গুটিকয়েক দেশ। ছোট ছোট দেশগুলো তাদের নিজের টাকায়, তাদের বুদ্ধি-বিবেচনামতো যেকোনো দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে না। কোন দেশ থেকে কোন পণ্য আমদানি করবে বা কোন দেশে কোন পণ্য রপ্তানি করবে—এসবের জন্য অলিখিত একটি বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে আমেরিকা, কানাডাসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশ। এসব দেশ জানে, ছোট দেশগুলো তাদের কথা মানতে বাধ্য, তাদের আদেশ-নির্দেশ মানতে বাধ্য।
আবার যে কয়টি দেশের কথা উল্লেখ করলাম তারা বৃহৎ শক্তির কাছাকাছি কিছু দেশকে অতটা ভয় দেখায় না, তাদের মাথার ওপরে স্যাংশনের কোনো খড়্গ দাঁড় করিয়ে রাখে না। ওই সব দেশ আবার কিছুটা সামর্থ্য অর্জন করেছে। কারণ, তারা নিজস্ব সম্পদ দিয়ে তাদের বার্ষিক খরচ মেটায় অথবা বড় দেশগুলো তাদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে বাণিজ্যে জড়িয়ে আছে। উদাহরণস্বরূপ ভারত, চীন, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু বড় দেশ রাশিয়া থেকে তেল কিনছে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই। আমরা যারা ছোট দেশ, আমরা বর্তমানে রাশিয়া থেকে তেল কেনার কথা চিন্তাও করতে পারছি না। ওই যে নিষেধাজ্ঞা, ওই যে স্যাংশনের ভয়! আমরা সব সময় তটস্থ থাকি, যদি তৈরি পোশাক বা অন্য কিছু পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে আমাদের ৫০ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে যাবেন। ২০০৪ সালে র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে যে কাজ করেছিল, সেই একই রকমভাবে তাদের কাজকর্ম ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত ছিল। এই ধারাবাহিকতার মাঝখান থেকে কয়েকজন অফিসারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বুঝিয়ে দিল, তাদের কথা না শুনলে খবর আছে! যদিও র্যাবের ট্রেনিং হয়েছিল আমেরিকায়।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু সরঞ্জাম এল। আমেরিকার সেই ভয়ের কারণে রাশিয়ার জাহাজে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ওই জাহাজের অতিপ্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ প্রথমে খালাস হলো ভারতে, তারপর বাংলাদেশে ওই একই যন্ত্রাংশ এল। শুধু যানবাহনের পরিবর্তন হলো ভারতে ট্রানজিট করে। আমাদের খরচ বেড়ে গেল মিলিয়ন ডলার!
আমরা বলতে চাই, আমাদের রিজার্ভ দিয়ে, আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে, আমরা বাণিজ্য করতে চাই মুক্তভাবে। যে দেশ থেকে আমরা সস্তা পাব, সেই দেশ থেকেই আমাদের সুবিধামতো পণ্য আমদানি করব। যে দেশে বেশি দাম পাই, আমাদের উৎপাদিত পণ্য সেই দেশে বিক্রি করব। আমরা ছোট বলে আমাদের ওপরে এই নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশনের ভয় কেন? সেই আগের কথায় ফিরে আসি। আমরা কারও কাছে মাথা বিক্রি করিনি বা আমাদের মাথা কেউ কিনে নেয়নি।
আমাদের একটাই দাবি—নিজের মতো করে বাণিজ্য করতে চাই, যেকোনো দেশের সঙ্গে বিনা বাধায়, বিনা নিষেধাজ্ঞা বা স্যাংশনের ডরভয় ছাড়াই।
লেখক: প্রকৌশলী