বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজারব্যবস্থাকে মেনে নিলেও কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ১২-১৩ টাকা রয়ে গেছে। তারা নির্দেশ দিয়েছে ১০৬ টাকা দরে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে এবং এক টাকা দাম বাড়িয়ে ডলার বিক্রি করবে।
বাংলাদেশে ডলারের কার্ব মার্কেটে পাগলা ঘোড়ার মতো দামের উল্লম্ফন থামানো যাচ্ছে না। গত মার্চে কার্ব মার্কেটে ১ ডলারের দাম ছিল ৯০ টাকার মতো।
গত ১৬ আগস্ট কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাতে লাফাতে ১২০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর কয়েকটি ব্যাংক এবং মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের কঠোর অভিযানের কারণে ২২ আগস্ট তা আবার ১০৮ টাকায় নেমে এসেছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর ডলারের দাম আবার ১১৯ টাকায় উঠে গেছে। কার্ব মার্কেটের এহেন বেলাগাম মূল্যস্ফীতি থামানোর জন্য প্রাথমিকভাবে ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছিল। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এইচএসবিসি ব্যাংক, ইস্টার্ণ ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া এবং ইসলামী ব্যাংকের কাছেও তাদের অস্বাভাবিক বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাখ্যা চেয়েছে।
উল্লিখিত ব্যাংকগুলো এই কয় মাসে ডলার বাজারে কৃত্রিম জোগান-সংকট সৃষ্টি করে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত অবৈধ মুনাফা তুলে নিয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে সরকার লাইসেন্স দিলেও প্রকৃতপক্ষে প্রায় ৬০০ প্রতিষ্ঠান কার্ব মার্কেটে অবৈধভাবে ডলার কেনাবেচায় অপারেট করছে। এই মানি এক্সচেঞ্জগুলোর অধিকাংশই দাঁও মারার এই স্বর্ণ-সুযোগের অপব্যবহার করে, বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে কৃত্রিম জোগান-সংকট সৃষ্টি করে, ডলারের দাম ম্যানিপুলেট করে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছে। কিছু মানি এক্সচেঞ্জার হুন্ডির দেশীয় এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ডলারের বাজারে বিভিন্ন ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে অধিষ্ঠিত অথবা অতীতে কর্মরত বিশিষ্ট ব্যাংকার ডলার বাজারের বর্তমান ফাটকাবাজিতে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক এসব চিহ্নিত ফাটকাবাজারির বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
ডলার বাজারের বর্তমান বেলাগাম অস্থিরতার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদেশে অব্যাহত পুঁজি পাচার। ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। (মানে, সিআইডির দাবি, ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না। অথচ এই পরিমাণ টাকা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে জমা হয়ে যাচ্ছে)। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে, প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি-প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ শতাংশ কমে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ ওই বছর হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হওয়া। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডির ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। এই প্রবৃদ্ধির কারণেই ওই দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে বড়সড় উদ্বৃত্ত হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল।
এরপর শুরু হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন। ২০২২ সালের ১২ জুলাই রিজার্ভ কমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা মোতাবেক ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এই ঘোষণা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কারণ, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলারের ‘রিফাইনেন্সিং স্কিমের’ অধীনে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রপ্তানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে, সেটাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছে আইএমএফ। তার মানে, বাংলাদেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তখন ছিল ৩২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এলসি ব্যয় পরিশোধ আগস্ট মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন সেপ্টেম্বরেও অব্যাহত রয়েছে। এর মানে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা মোতাবেক রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। (আইএমএফের নির্দেশনা মানলে প্রকৃত রিজার্ভ এখন সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলার)!
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজারব্যবস্থাকে মেনে নিলেও কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ১২-১৩ টাকা রয়ে গেছে। তারা নির্দেশ দিয়েছে ১০৬ টাকা দরে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে এবং ১ টাকা দাম বাড়িয়ে ডলার বিক্রি করবে। কিন্তু এই দামে ক্রেতারা ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারছেন না। এই দুই দামের এত বড় পার্থক্য শুধু হুন্ডিব্যবস্থাকেই চাঙা করছে, যার ফলে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে বাধ্য। (অর্থমন্ত্রীর মতে, দেশের রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ এখন হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় দেশে আসছে। আমার মতে, অধিকাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডিব্যবস্থায় দেশে আসছে)! আমি আবারও বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য দায়ী পাঁচটি প্রধান পুঁজি পাচার-প্রক্রিয়া: ১. আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির আড়ালে ওভারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে জোরেশোরে বিদেশে পুঁজি পাচার, ২. রপ্তানিতে ব্যাপক আন্ডারইনভয়েসিং পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার, ৩. রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে দিয়ে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক, ৪. দেশের ব্যাংকঋণ নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠীগুলো কর্তৃক হুন্ডিওয়ালাদের ঋণের টাকা প্রদানের মাধ্যমে এর সমপরিমাণ ডলার হুন্ডি-প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার এবং ৫. সাম্প্রতিক কালে চালু করা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ বিদেশে পাচার। তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে।
অর্থমন্ত্রী কি আদৌ তা করছেন? এবারের বাজেটে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনতে চাইলে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, গত আড়াই মাসে কেউ এই সুবিধা নেননি। আমদানিতে ওভারইনভয়েসিং মনিটরিং করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, তার কোনো হদিস মিলছে না। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই ও ইতালিতে আটটি তদন্ত টিম পাঠানো কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে পুঁজি পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, সে ব্যাপারেও কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না! এমনকি, রপ্তানি আয় রপ্তানিকারকদের নিজের কাছে রেখে দেওয়ার পরিমাণকে (অনুপাতকে) আগামী কিছুদিনের জন্য কঠোরভাবে সীমিত করা এবং একই সঙ্গে কত দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হবে, সে সময়সীমাকেও কঠোরভাবে নামিয়ে আনা-সম্পর্কিত পরামর্শকেও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। অথচ, সরকার স্বীকার না করলেও ওয়াকিবহাল মহল ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৩ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ। (ভিয়েতনামের মুদ্রার তেমন কোনো অবচয়নই হয়নি)। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের এই দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা।
লেখক: ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়