হোম > ছাপা সংস্করণ

সোহেল তাজের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও কিছু কথা

জাহীদ রেজা নূর

ভেবেছিলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের সদস্যদের বেশুমার অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতনের বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে যারা, তাদের পরিচয় ছাত্রলীগ। স্থানীয়ভাবে নানা অপকর্মের সঙ্গে ছাত্রলীগের সদস্যদের নাম উঠে আসছে। ছাত্রলীগের সদস্যদের এই নৈতিক পতনের কারণ খুঁজতে হবে তাদের আদর্শহীনতার মধ্যে। যে ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে এই ছাত্রসংগঠনটির এবং যে সংগ্রাম ও ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে আওয়ামী লীগ, সেই ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংগ্রাম সম্পর্কে ধারণা থাকলে তারা এই সব অপকর্ম করে বেড়াতে পারত না। মুশকিল হলো, এখন ছাত্ররাজনীতি বা রাজনীতি করতে হলে আদর্শের চেয়ে পেশিশক্তি বা ট্যাঁক-শক্তির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে দলের মধ্যে আদর্শের চেয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক দলের ও ছাত্রসংগঠনের মধ্যে নৈতিকতা কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে পড়াশোনা, কমে যাচ্ছে সাধারণ জনগণের সঙ্গে সংলগ্নতা। তাতে যা হওয়ার ছিল, সেটাই ঘটেছে।

এ বিষয়টি নিয়ে যখন লিখতে বসেছি, তখন হঠাৎ করে তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে বাংলাদেশের একসময়ের প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য সোহেল তাজের একটি ফেসবুক মন্তব্য চোখে পড়ল। ফেসবুকে সোহেল তাজের উত্থাপিত বিষয়টি খুবই সংগত। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের জন্মবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফেসবুকে একটি পোস্ট আশা করেছিলেন তিনি। পরে আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সোহেল তাজের স্ট্যাটাসের উত্তরে একটা ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়।

সোহেল তাজের মন্তব্যের পর আওয়ামী লীগ তাদের ফেসবুক পেজে তাজউদ্দীন আহমদকে স্মরণ করেছে, তাতে তাজউদ্দীন আহমদের শুধু নয়, দল হিসেবে আওয়ামী লীগেরও সম্মান বাড়ল। দলের একজন শক্তিমান সদস্য, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পার্শ্বচর ছিলেন, তাঁকে ঠিকভাবে স্মরণ করা হলে নতুন প্রজন্ম আমাদের সংগ্রামের ইতিহাসের একজন মূল চরিত্রের সঙ্গেও পরিচিত হতে পারে, এ কথা ভুলে গেলে চলবে কী করে?

সংকটটা এই নয় যে প্রশ্নটা শুধু তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে উঠে আবার হারিয়ে যাবে।

আমাদের দেশে রাজনীতি হয়ে গেছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। মুখে বলছি গণতন্ত্র আমাদের চালিকাশক্তি, অথচ কাজের সময় গণতান্ত্রিক পথটা বেছে নিচ্ছি না। এই সংকট প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই রয়েছে। দলের চেয়ে ব্যক্তি বড় হয়ে গেলে কী ধরনের সর্বনাশ হয়, তা আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি। লেনিনকে সেখানে প্রায় ঈশ্বর বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। এমনকি পাঠ্যপুস্তকের যেকোনো বিষয়েই লেনিন কী বলেছেন, তা নিয়ে আলোচনা ছিল। সেই আলোচনা আবার পরীক্ষাতেও আসত। যেকোনো কিছুরই বাহুল্য জনমনে বিতৃষ্ণার জন্ম দেয়। ভেবে দেখতে হবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও কেউ যেন সেভাবে ব্যবহার করতে না পারে। আশার দিক, বহু তাঁবেদার মানুষ পদ্মা সেতুর নাম রাখতে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে। প্রধানমন্ত্রী সে ভাবনার কোনো মূল্য না দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি তেলবাজি পছন্দ করেন না।

দুই.
১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমেই মূলত শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের রাজনীতিতে একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন একজন ক্যারিশমাটিক লিডার। ষাটের দশকে বাঘা বাঘা সব আন্তর্জাতিকতাবাদী-সাম্যবাদী অথবা ইসলামি নেতাদের অগ্রাহ্য করে বাংলার জনগণ তাদের মুক্তিদাতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। ছয় দফার ব্যাপারে আপসহীন থেকে শেখ মুজিবুর রহমান যখন একের পর এক বক্তৃতা করছিলেন, তখন নিজের ভাবনাগুলোকে স্পষ্ট করে তুলে ধরছিলেন তিনি। এ সময় যাঁরা রাজনীতি, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি পরিমণ্ডলে বাঙালির এই জাগরণ নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছিলেন, তাঁদের মূল্যায়ন করা না হলে বঙ্গবন্ধুকে ঠিকভাবে তুলে ধরা যাবে না। বঙ্গবন্ধু কী করে পুরো জাতির নয়নের মণি হয়ে উঠলেন, সেটা তো খুঁজতে হবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, সেই সময়ের মানুষদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে। নইলে মূল্যায়নটা হবে ভারসাম্যহীন।

বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করলেই বোঝা যায়, তিনি নিজ দলের, অন্য দলের নেতা-কর্মীদের কতটা সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধুর রক্তের মধ্যেই ছিল, অন্যকে সম্মান করলে নিজে সম্মানিত হওয়া যায়। নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদেরও নেমে পড়তে হবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে। অন্য যেকোনো পথ পরিত্যাজ্য।

তিন.
দলীয় মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য কী পদক্ষেপ নিতে পারে কোনো রাজনৈতিক দল? তারা দলের শুভাকাঙ্ক্ষী অথবা সদস্যদের অবদান তুলে ধরতে পারে। ছয় দফা প্রচারের জন্য ইত্তেফাক যে ভূমিকা পালন করেছে, তার তুলনা পাওয়া ভার। সম্পাদকীয় পাতায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার লেখা উপসম্পাদকীয় এবং বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের নিউজ ট্রিটমেন্ট মিলেই ছয় দফা আন্দোলন পৌঁছে গেছে জনগণের দ্বারে। সত্তরের নির্বাচনের সময় মানিক মিয়া আর বেঁচে ছিলেন না। তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রচারের ভার বহন করেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু সিরাজুদ্দীন হোসেন। সে সময়কার ইত্তেফাকের নিউজ ট্রিটমেন্ট দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এই দুজন অকুতোভয় সাংবাদিকের কি মূল্যায়ন হয়েছে আওয়ামী লীগে? তাঁরা দলীয় চাঁদা দেওয়া আওয়ামী লীগার ছিলেন না বটে, কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দেখানো পথেই তাঁরা চলেছেন। বলা বাহুল্য, মানিক মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান এবং সিরাজুদ্দীন হোসেন কখনোই সোহরাওয়ার্দীর দেখানো পথ থেকে সরে দাঁড়াননি। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষেই সোচ্চার ছিলেন তাঁরা।

‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ স্লোগানকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে তুলে ধরার জন্য যে অর্থনীতিবিদেরা তাঁদের মেধা খাটিয়েছেন, তাঁদেরই-বা স্মরণ করা হবে না কেন? পাকিস্তানের দুই অংশে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ফুটে উঠেছিল, সে বৈষম্যের কথা দৃঢ়ভাবে বলার জন্য দরকার ছিল তথ্য-উপাত্তসহ তার প্রমাণ। সে কাজটাই তো করেছিলেন নূরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, আনিসুর রহমান প্রমুখ। সে সময় তাঁরা কীভাবে বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে কথা স্মরণ না করে কি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা যাবে?

রাজনীতির মাঠে জেলহত্যার শিকার চার নেতার কথা কি ভোলা উচিত হবে? মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা ধরনের বিরোধিতার মুখেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানের দৃঢ়তাপূর্ণ নেতৃত্বকে স্মরণ করা হলে কারও কোনো ক্ষতি তো হওয়ার কথা নয়।

আর ছাত্রনেতাদের কথা? ছয় দফার কারণে আওয়ামী লীগের নেতারা যখন জেলে বন্দী, তখন ছাত্রনেতারাই তো এগিয়ে নিয়ে গেছেন এই আন্দোলন। মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজদের অবদানও কম নয়। আওয়ামী লীগের আমেনা বেগম তখন রেখেছিলেন দৃঢ় ভূমিকা। তবে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রনেতারা যে অবদান রেখেছেন, মুক্তভাবেই তা স্মরণ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ ত্যাগ করলেও সেই ঐতিহাসিক সময়ে তাঁদের ভূমিকার নিরপেক্ষ আলোচনা হওয়াই সংগত। কেন ছাত্রলীগের চারজন নেতাকে চার খলিফা বলা শুরু করল মানুষ, সেটাও তো বিবেচনায় আনা দরকার।

অন্যদিকে সিরাজুল আলম খানের মতো এত বড় সংগঠক, বঙ্গবন্ধুও যাঁকে আমলে নিতেন, তাঁর হঠকারী ভূমিকার কথাও তো সঠিক ইতিহাসের স্বার্থে তুলে আনতে হবে। তাঁকে নিয়েও আলোচনা হতে হবে দলীয় সভায়। আলোচনা হতে হবে শেখ ফজলুল হক মণিকে নিয়েও।

চার.
কীভাবে কাজটা করা সম্ভব?

আওয়ামী লীগ এখন অনেক বড় দল। দলের গবেষণা সেলও নিশ্চয়ই অনেক গুণী মানুষদের নিয়ে গঠিত। তাঁরাই বিভিন্ন সময় ইতিহাসের স্বরূপ সন্ধানে সেমিনারের আয়োজন করতে পারেন। প্রকাশ করতে পারেন বই, যা হয়ে উঠতে পারে ঐতিহাসিক দলিল। তৈরি করাতে পারেন তথ্যচিত্র।

যে কাজগুলো করার কথা বললাম, সেগুলো করার সময় মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের সমর্থন ছাড়া কোনো তথ্য যেন সেখানে জায়গা না পায়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ইতিহাস বিকৃত করেও কেউ কেউ কোনো তথ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে সঠিক তথ্য জানা গেলে ওই একটি বিকৃত তথ্যের কারণেই পুরো প্রয়াসটা ব্যর্থ হয়ে যায়।

যাঁকে নিয়ে সেমিনার করা হবে কিংবা যাঁকে নিয়ে বই লেখা হবে বা তথ্যচিত্র তৈরি করা হবে, তাঁকেই যেন ওই প্রয়াসের মূল ব্যক্তি করা হয়।

এই কাজগুলো দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের যেমন তুলে ধরবে, তেমনি বুঝতে দেবে, বঙ্গবন্ধু তাঁর আরাধ্য পথে এগিয়ে যেতে পেরেছেন ঠিক মানুষদের, ঠিক সময়ে কাছে পেয়েছিলেন বলেই। এ কথা মেনে নিয়ে যখন আমরা ইতিহাসচর্চা করতে যাব, তখন ইতিহাসের অনেক জটিল জটও খুলে যাবে দ্রুত। তখন আর সোহেল তাজের মতো ফেসবুকে এ রকম স্ট্যাটাস দিতে হবে না।

লেখক: উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ