ঢাকা শহরের বর্তমান লোকসংখ্যা কত, সে-সংক্রান্ত সঠিক হিসাব কারোরই জানা নেই এবং প্রকৃত অর্থে তা জানা সম্ভব বলেও মনে হয় না। কারণ, জনমিতি তত্ত্বের কোনো স্বীকৃত ধারণা, জ্ঞান বা প্রাক্কলনই এ শহরের জনসংখ্যা ও এর প্রবণতা নিরূপণে হুবহু প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। বস্তুত এ এক অদ্ভুত শহর। এখানে পেশাগত কাজের সুবাদে যত মানুষ বসবাস করে, তার চেয়ে অনেক বেশি বসবাস করে কোনো কাজ ছাড়াই। এ ছাড়া অস্বীকৃত পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, যারা এর বসবাসের পরিধিকে আরও জটিল করে তুলেছে, যাদের মধ্যে রয়েছে পলাতক আসামি, রাজনৈতিক টাউট ও তদবিরকারক, আদম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত দালাল, জমি বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত টাউট, ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মেম্বার, কর্মানুসন্ধানী বেকার ইত্যাদি অনেকেই।
উল্লিখিত নিয়মিত বসবাসকারীরা ছাড়াও ঢাকায় রয়েছে আরও একধরনের অস্থায়ী বসবাসকারী মানুষ। তাঁদের কেউ কেউ নিকটবর্তী জেলাগুলো থেকে রাজধানীতে এসে কাজ সেরে দিনেই গ্রামে ফিরে যান। আর দূরবর্তী জেলাগুলো থেকে একই প্রকৃতির যাঁরা আসেন, তাঁরা দিনে দিনে ফিরে যেতে পারেন না বলে এক-দুদিন আত্মীয়স্বজনের বাসায় কিংবা একটু সামর্থ্যবানেরা হোটেলে থেকে পরে গ্রামে ফেরেন। আর তাঁদের মধ্যে রয়েছে চিকিৎসাপ্রার্থী রোগী ও তাঁদের সঙ্গে আসা আত্মীয়স্বজন, উচ্চ আদালতের মামলার তদবিরকারক, নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী, বিদেশগামী ও বিদেশ থেকে আসা প্রবাসী, স্বল্পপুঁজির বিক্রেতা, নিম্ন আয়ের কর্মজীবী প্রমুখ।
ঢাকায় স্থায়ী বা অস্থায়ী ভিত্তিতে বসবাসকারী এসব মানুষের বৈশিষ্ট্যের ধরন আরও নানাভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। তবে এ নিবন্ধে সেই বিশ্লেষণের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজধানী থেকে মানুষের সংখ্যা কীভাবে কমানো যাবে, তা নিয়ে আলোচনা করা। আর সে আলোচনায় প্রবেশের আগে ঢাকার প্রকৃত লোকসংখ্যা সম্পর্কে একটি ন্যূনতম প্রাথমিক ধারণা অর্জন করা উচিত বলে মনে করি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা শহরের লোকসংখ্যা এখন ২ দশমিক ১৭ কোটি এবং তা বার্ষিক ৩ দশমিক ৬১ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রাজধানীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এর চেয়েও অনেক বেশি বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এবং তাঁদের সেই ধারণা মানলে স্বাভাবিকভাবেই এখানকার জনসংখ্যা ২ দশমিক ৫০ কোটির কাছাকাছি হবে বলে মনে হয়। এখন এই আড়াই কোটি মানুষকে নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন: প্রথমত, রাজধানী ঢাকার যে আয়তন, তাতে ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণ করে এটুকু জায়গার মধ্যে ২ দশমিক ৫০ কোটি লোকের বসবাসের ব্যবস্থা করা সম্ভব কি না। জবাব হচ্ছে: না, প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সামর্থ্য থাকলেও না।
দ্বিতীয়ত, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার আওতায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি উঁচুমাত্রার বিনিয়োগের আওতায় এটি করা সম্ভব; তাহলেও প্রশ্ন আসে, ঢাকার লোকসংখ্যা কি আগামী এক দশক ধরে এ আড়াই কোটিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? মোটেও না; বরং চলতি ব্যবস্থা ও ধারা অব্যাহত থাকলে প্রতিবছর ঢাকার লোকসংখ্যা অন্তত ৪ শতাংশ হারে, অর্থাৎ ১০ লাখ করে বাড়বে। তার মানে হচ্ছে, উল্লিখিত উচ্চ বিনিয়োগসম্পন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে ২ দশমিক ৫০ কোটি লোককে কোনোরকমে সামাল দেওয়া সম্ভব হলেও ২০৩১ সাল নাগাদ নতুন করে আরও ১ কোটি লোক ওই পরিকল্পনা-সুবিধার বাইরে থেকে যাবে।
তৃতীয়ত, ঢাকা শহরে ভূমির কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবহার পরিকল্পনা না থাকায় এখানে নানাবিধ অবকাঠামো একেবারে যথেচ্ছভাবে গড়ে উঠছে। নানাবিধ অদক্ষতা এবং স্বার্থ ও দ্বন্দ্বের টানাপোড়েনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন ড্যাপ (ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) আজ এত বছরেও স্থির হতে পারেনি। আর সেই ফাঁকে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যে যার মতো করে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত স্থাপনার সংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। ফলে এই শহর শুধু জঞ্জালেই পরিণত হচ্ছে না, এর সীমিত ভূমির কাম্য ব্যবহার ও উপযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এবং বিদ্যমান জনসংখ্যার ভার যতটুকু বহন করতে পারত, ততটুকু বহনেও অক্ষম হয়ে পড়েছে।
ঢাকার বিদ্যমান সমস্যাদি নিয়ে এভাবে তালিকা করতে থাকলে তা শুধু দীর্ঘই হবে না, একই সঙ্গে তা বিরক্তিকরও হয়ে উঠবে। অতএব এ আলোচনায় সমস্যার তালিকা দীর্ঘ করার চেয়ে বরং এ থেকে বেরোনোর কোনো উপায় আছে কি না, তা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা যেতে পারে। আর সে আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসন যেভাবে অধিকেন্দ্রায়নের বলয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাতে সামনের দিনগুলোয় গ্রাম থেকে মানুষের ঢাকামুখী অভিগমনপ্রবণতা আরও বাড়বে বলেই মনে হচ্ছে। অতএব ঢাকার লোকসংখ্যা কমানোর লক্ষ্যে একেবারে প্রথম সুপারিশ হচ্ছে, রাজনীতি ও প্রশাসনকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিক দল ও প্রশাসন কোথাও এ বিকেন্দ্রীকরণ নেই। রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠন বা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও দেখি কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ লাগে। অন্যদিকে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টি ক্ষমতা ও স্বার্থহানির ভয়ে এর সদস্যরা নিজেরাই চান না। এ অবস্থায় সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে রাজধানীতে যত অবকাঠামো উন্নয়ন পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, তাতে এর বসবাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে আদৌ কোনো উন্নতি ঘটবে বলে মনে হয় না। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কি সেটি উপলব্ধি করে শুধু গঠনতান্ত্রিকভাবে নয়, বাস্তব চর্চায় দলের মধ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে সম্মত হবে?
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়টিতে ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা এই যে, এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বরাবর আমলাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এর বাস্তবায়ন ও পরিধারণের দায়িত্বও তাঁরাই পালন করেছেন। কী অদ্ভুত চিন্তাভাবনা! যার ক্ষমতা কর্তন করতে হবে, তাকেই বলা হচ্ছে সেটি করার জন্য। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বরাবরের মতো রাজধানীতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকছে। আর এর অনিবার্য ফল হিসেবে অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় সেবা ও সিদ্ধান্ত পাওয়ার জন্য জনগণকে বারবার রাজধানীতেই ছুটে আসতে হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশে যেসব নয়া কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তারও অধিকাংশ হচ্ছে রাজধানী ও তৎসন্নিহিত এলাকায়। ফলে কর্মানুসন্ধানী মানুষ যে শুধু নিজের প্রয়োজনেই রাজধানীর দিকে ছুটছেন তা নয়, কর্মদাতারাও তাঁদের প্রয়োজনে মানুষকে ঢাকার দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। এ অবস্থায় কৃষিবহির্ভূত খাতের কর্মসংস্থান ঢাকা ও এর চারপাশ এড়িয়ে রাজধানী থেকে যত বেশি দূরবর্তী এলাকায় করা যাবে, ঢাকার ওপর জনসংখ্যার চাপ ততই কমবে। কিন্তু এটি তো শুধু মুখের আহ্বানে হবে না। এ জন্য প্রয়োজন উন্নয়ন পরিকল্পনায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনা। পোশাক রপ্তানিতে নগদ ভর্তুকিসহ শিল্প খাতে বর্তমানে যেসব প্রণোদনা রয়েছে, সেগুলো শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়ন এবং মুনাফার পরিমাণ বৃদ্ধিকে সহায়তা করছে বটে। কিন্তু এসবের প্রায় কোনোটিই শিল্পকে ঢাকা থেকে দূরবর্তী নির্দিষ্ট এলাকায় স্থাপনের জন্য উৎসাহদান করে না। ফলে বিশেষ গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্যমূলক প্রণোদনাদানের নীতিসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে এমন সব ব্যবস্থা করা উচিত, যা উদ্যোক্তাকে ঢাকার বাইরে শিল্প স্থাপনে উৎসাহদানের পাশাপাশি সেটি অনুসরণ তাদের জন্য বাধ্যতামূলকও হবে।
সব মিলিয়ে, ঢাকামুখী জনস্রোত কমানোর সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে দেশের স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ এবং সেই সরকারের হাতে কর আদায়, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর (বিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি) পরিচালনা, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি সমুদয় কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত করা। আর এটি করতে হলে একই সঙ্গে যা করতে হবে তা হচ্ছে, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে। বস্তুত স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণ ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে একটি যুগপৎ প্রক্রিয়া এবং এই যুগপৎ প্রক্রিয়ার সমন্বিত বাস্তবায়নই কেবল ঢাকার জনসংখ্যাকে মোটামুটি একটি নিয়ন্ত্রণসীমার মধ্যে রাখতে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। আর বাস্তবতার খাতিরে বলা প্রয়োজন যে ঢাকা শহরের লোকসংখ্যাকে গ্রহণযোগ্য নিয়ন্ত্রণসীমার মধ্যে রাখতে না পারলে এর ভৌত-কাঠামোগত উন্নয়নে যত পরিকল্পনাই
গ্রহণ করা হোক না কেন, তা এই নগরীর অধিবাসীদের চাহিদা পূরণে কখনোই সক্ষম হয়ে উঠবে বলে মনে হয় না।
লেখক: আবু তাহের খান পরিচালক স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ;
সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়