দেশের অন্যতম প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দেশব্যাপী বিভাগীয় সমাবেশ করছে। যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া, ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের দ্বারা কিছু খুচরা হামলার শিকার হওয়া সত্ত্বেও সমাবেশগুলোতে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন পর নিষ্ক্রিয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের এই জেগে ওঠায় রাজনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরাও নতুন করে চাঙা হয়ে উঠছেন। নেতাদের কথায়ও বেশ একটা ‘ক্ষমতায় যাব যাব ভাব’ চলে এসেছে। যদিও বিএনপির এই জেগে ওঠায় রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কোনো আভাস
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, বিএনপি এখনো খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বাইরে কোনো নেতাকে উপস্থাপন করতে পারছে না। আর এটাই এই মুহূর্তে দলটির সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা।
ধরা যাক, বিএনপির আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাসীনেরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারকাঠামো ফিরিয়ে এনে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিল, সেই নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, তারপর কী হবে? কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে কিংবা তারেক রহমানকে ফিরিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রী বানানো হবে? কিন্তু এর জন্য তো তাঁদের আগে নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। আর নির্বাচিত হয়ে আসার আগে রাষ্ট্রপতির দ্বারা সাধারণ ক্ষমা পেতে হবে। এত সব প্রক্রিয়া শেষ করার আগে কে হবেন দলের প্রধান নেতা? মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর? বিএনপির অন্য নেতারা তা মানবেন?
এ কথা অনস্বীকার্য যে বিএনপির প্রাণভোমরা হচ্ছে জিয়া পরিবার। সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর দলটি প্রতিষ্ঠা করার পর এই পরিবারের মাধ্যমেই দলটি বিকশিত হয়েছে, জিয়া পরিবারই দলটিকে পরিচালিত করেছে। এই পরিবারের বাইরের কেউ দলের প্রধান হলে জনসমর্থন ও ঐক্য থাকবে বলে মনে হয় না। কাজেই বিএনপির নেতাদের আস্ফালন কিংবা কর্মী-সমর্থকদের চাঙা হয়ে ওঠা—শেষ পর্যন্ত অন্তঃসারশূন্য হিসেবে বিবেচিত হতে বাধ্য।
এক যুগ ধরে চরম দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে দলটি চলছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান একসঙ্গে মাইনাস হয়ে গেছেন। দুর্নীতির দুটি মামলায় ১০ এবং ৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার। বর্তমানে তিনি সরকারের বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করার শর্তে জেলখানার বাইরে রয়েছেন। কিন্তু সরকার চাইলে তাঁকে যেকোনো সময় জেলে পাঠাতে পারে। তারেক রহমানেরও দুর্নীতির দুটি মামলায় ৭ ও ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। এ ছাড়া ২১ আগস্টের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তাঁর। এসব দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় বিএনপি আগামী নির্বাচনে ভালো ফল করলেও দলের সংকটমোচন হবে না; বরং তাতে দলের পাশাপাশি দেশের সংকট আরও গভীর হবে।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপির বর্তমান দুর্দশার জন্য কে দায়ী, সে প্রশ্নটিও ঘুরেফিরে আসছে। অনেক বিশ্লেষকের মত হচ্ছে, খালেদা জিয়া এবং বিএনপির আজকের এই পরিণতির জন্য দায়ী তারেক রহমান। আর মা হিসেবে সন্তানকে শাসন করার ব্যর্থতাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। ক্ষমতার মোহে বিপথগামী সাবালক সন্তানকে তিনি শাসন করতে পারেননি। আর পারেননি বলে তিনি নিজে আজ করুণ পরিণতির সম্মুখীন। তারেক রহমান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের পরিকল্পনায় ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা করে শেষ করে দিতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের। এ ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য জেনেও তিনি ছেলেকে বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন বেআইনি পন্থার। নিজের শাসন আমলে বিচার করেননি এ অপরাধের; বরং দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগের ওপর। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার নোংরা খেলায় ছেলের অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেছেন। এতিমদের জন্য আনা টাকা নয়ছয় করার খেলায়ও ছেলের সঙ্গী হয়েছেন। পরিণতিতে এই শেষ জীবনে এসে নানা রোগব্যাধি নিয়ে নিঃসঙ্গ কারাবাস করছেন। ভোগ-বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জীবনে এর চেয়ে নির্মম পরিণতি আর কী হতে পারে?
ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পরে খালেদা জিয়া একবারও এ দেশের গণমানুষের কোনো সমস্যার বিষয় নিয়ে আন্দোলন বা কোনো কর্মসূচি দেননি। দশম জাতীয় নির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়ে হরতাল, অবরোধ আর আগুন-সন্ত্রাসের মাধ্যমে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে মারার দায় বহন করেছেন। দলের নেতৃত্ব পরিবারের বলয়ের বাইরে যেতে দেননি। বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলনের পর একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বিএনপির নেতাদের প্রশ্ন করেছিলেন, দলের চেয়ারপারসন যখন দণ্ডিত, তখন আর একজন দণ্ডিত এবং বিদেশে নির্বাসিতকে কেন আবার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হলো? সেই প্রশ্নের জবাব কোনো নেতা দিতে পারেননি।
আগামী দিনে বিএনপির হাল ধরার মতো নেতা কে—এ প্রশ্নের উত্তরও বিএনপির নেতারা জানেন না। এমন বাস্তবতায় যাঁরা বিএনপির নেতৃত্বে ক্ষমতা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন, তাঁরা আসলে আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছেন।
এটাও ঠিক যে আমাদের দেশে অসম্ভব বলে কিছু নেই। অসংখ্য নদীবাহিত পলিমাটির এই বাংলাদেশে তিনটি জিনিস খুব ভালো জন্মে। এক. অতি অল্প পরিশ্রমে সোনার ফসল। দুই. মানুষ। আর তিন. মীরজাফর। এ দেশে মীরজাফরের অভাব নেই। যুগে যুগে নানা সময়ে তাদের আবির্ভাব লক্ষ করা গেছে। এই মীরজাফরেরা অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে!
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে আপাতত বিএনপি নামের ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’র ভবিষ্যৎ কী বা জিয়া পরিবারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কোন পথে—তা অনেকটাই অস্পষ্ট। তারেক রহমান লন্ডনে বসে মোটাদাগে বিএনপির কর্মসূচি ঠিক করে দিতে পারেন, কিন্তু খুঁটিনাটি অসংখ্য সমস্যার সমাধান কি দিতে পারেন? ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের অ্যাপস ব্যবহার করে কি দল চালানো বা দলের নেতৃত্ব দেওয়া আদৌ সম্ভব?
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব চেয়েছেন বলেই কিন্তু বিএনপি এখন সভা-সমাবেশের অনুমতি পাচ্ছে। কিছু বাধাবিপত্তি এসেছে বটে, কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমাবেশ বানচালের মরিয়া প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। ক্ষমতাসীনেরা চায়নি বলে কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দৌড়ের ওপর জীবন কাটিয়েছেন। কোনো সভা-সমাবেশ করার অনুমতিই পায়নি। বিএনপিকে একটু একটু করে সুযোগ দিয়ে রাজপথে নামিয়ে সেখান থেকে নির্বাচনের মাঠে আনতেই যে ক্ষমতাসীনদের এই নমনীয়তা, তা বলাই বাহুল্য।
পনেরো বছর ধরে টানা ক্ষমতায় থাকা একটা দলকে সহজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানাতে বাধ্য করা যাবে, এমন ধারণা বাতুলতা মাত্র। আর হ্যাঁ, বিএনপি আগ্রাসী হলে ক্ষমতাসীনেরাও ছেড়ে কথা কইবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়া অন্য কোনো যৌতুক আমাদের জীবনে আছে বলে মনে হয় না।
মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম-নিশানা মুছে ফেলার, বাংলাদেশ নামের দেশটির মোড়কে পাকিস্তানকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে। শুরুটা অন্যদের হাতে হলেও এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বিএনপি। দোসর হিসেবে পেয়েছে জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী সব দল-গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে।
এরপর শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য ঘটানো হয়েছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। কিন্তু দৈবক্রমে শেখ হাসিনা বেঁচে গেছেন! ব্যর্থ হয়েছে আরেকটি গভীর রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র।
কাজেই এই ‘ঘাতক বিএনপি’র সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংঘাত মিটবে কীভাবে, কোন শর্তে? বাংলাদেশের রাজনীতি তাই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত! হত্যা-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত চেয়েছিল ‘নিষ্কণ্টক ক্ষমতা’। আওয়ামী লীগ হত্যা-ষড়যন্ত্র নয়; বরং কৌশলে জামায়াত-বিএনপিকে ফাঁদে ফেলে ভোগ করতে চাইছে ‘নিষ্কণ্টক ক্ষমতা’!
বিএনপির ‘মৃত্যু’ কিংবা আওয়ামী লীগের ‘পুনর্জন্ম’ অথবা আওয়ামী লীগের ‘মৃত্যু’, বিএনপির ‘পুনর্জন্ম’ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির এই ব্যাধির আদৌ কোনো ওষুধ আছে কি? চিররঞ্জন সরকার