হোম > ছাপা সংস্করণ

তবু কেন এত কষ্ট?

আবু তাহের খান

বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের (বিসিজি) সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের সারমর্ম হচ্ছে, আসন্ন বছরগুলোতে বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার যদি বর্তমানের চেয়ে ২ শতাংশ কমেও যায়, অর্থাৎ ৫ শতাংশও হয় (২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশ), তাহলেও ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারের আকৃতিতে পৌঁছে যাবে। আর প্রবৃদ্ধির হার যদি ১০ শতাংশ হয়, তাহলে ওই পর্যায়ে পৌঁছাতে সময় লাগবে আর মাত্র আট বছর, অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদই বাংলাদেশ হবে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ। সব মিলিয়ে সাকল্য সম্পদ ও প্রবৃদ্ধি হারের বিবেচনায় এ এক তাক লাগানো অগ্রগতি বৈকি!

সম্পদ ও এর প্রবৃদ্ধি-হারের বিবেচনায় এই যে বিপুল অগ্রগতি, এরপরও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও টিকে থাকার সংগ্রাম কেন এত কষ্টময়? কেন ৪২ শতাংশেরও বেশি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে? কেন ৭৩ শতাংশ মানুষ এখনো স্বাস্থ্যকর খাদ্য জোগাড় করতে পারছে না? কেন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিনই কমছে? কেন প্রায় অর্ধকোটি মানুষের কোনো বাসস্থান নেই? কেন প্রায় ৫৩ লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে? কেন পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশ শিশু এখনো পুষ্টিহীনতায় ভোগে? কেন হ্রাস পাচ্ছে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হার? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান কেন এমন যে তাদের তৈরি করা স্নাতকদের সিংহভাগকেই চাকরিদাতারা কাজের উপযুক্ত বলে গণ্য করেন না?

প্রশ্ন এটিও যে এত বড় মাপের যে অর্থনীতি এবং এত উচ্চতর যার প্রবৃদ্ধির হার, তার ফলাফলটা তাহলে যাচ্ছে কোথায়, কে তা ভোগ করছে? আর এ ধরনের উন্নয়ন থেকে সাধারণ জনগণই-বা কতটুকু লাভবান হতে পারছে? এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে একেবারে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে এ দেশের ১৮ কোটি মানুষ একটি অভিন্ন রাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও তারা সবাই একই শ্রেণিগোষ্ঠীর মানুষ নয়। কিন্তু সম্পদ ও সম্পদ বৃদ্ধির হারের হিসাব কষতে গিয়ে সবাইকে গণ্য করা হচ্ছে অভিন্ন এককের (ইউনিট) অংশ হিসেবে। ফলে কাল্পনিক সম্পদের একটি বোঝা সম্পদধারীর পাশাপাশি সম্পদহীন বা প্রায় সম্পদহীন ব্যক্তির ঘাড়ে গিয়েও চাপছে, যা শুধু ভ্রান্তিপূর্ণই নয়, চরম ক্ষতিকারকও। কারণ, এই ভ্রান্তিপূর্ণ হিসাবের অঙ্ককে প্রচার ও ব্যবহার করেই রাষ্ট্রের সম্পদধারী ব্যক্তিরা একচেটিয়াভাবে আরও অধিক সম্পদ কুক্ষিগতকরণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে এবং শ্রেণিস্বার্থের সুবাদে রাষ্ট্রও নিরন্তর তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতাদানের প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে।

এদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সম্পদের মেরুকরণ ঘটতে ঘটতে তা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে রক্ষণশীল আনুষ্ঠানিক হিসাবেই ২৪ দশমিক ৭০ শতাংশ সম্পদের মালিক এখন দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ। আর এ সূত্রে সহজেই বোধগম্য যে এই ১ শতাংশরাই ওই ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের সিংহভাগের মালিক। ফলে রাষ্ট্রের অর্থনীতি স্ফীত হতে হতে তা যত বিশালাকারই ধারণ করুক না কেন, তাতে অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশের তেমন কিছুই যায়-আসে না; বরং তাদের জন্য মনোবেদনার কারণ এটি যে রাষ্ট্র তাদের নাম ব্যবহার করে লুটেরা সম্পদধারীদের নানা বৈধ ও অবৈধ পন্থায় আরও দ্রুত হারে সম্পদ করায়ত্তকরণের সুযোগ করে দিচ্ছে। এটি নিজেদের অবস্থানকে সাময়িকভাবে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হলেও রাষ্ট্রের মানবিক চরিত্রকে অনেকটাই ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরিই সাংঘর্ষিক।

ফলে বাংলাদেশ যে শিগগিরই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠছে, তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের খুশি হয়ে ওঠার তেমন কোনো কারণ নেই (ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হয়ে ওঠার বিরোধিতা করা হচ্ছে না); বরং কিছুটা হলেও আতঙ্কিত হওয়ার বিষয় রয়েছে এই ভেবে যে, ওই অবৈধ সম্পদধারীদের সম্পদ-সংগ্রহ প্রক্রিয়ার চাপে সাধারণ মানুষের জীবন না আরও দুর্ভোগপূর্ণ হয়ে ওঠে!

উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে এটি মোটামুটি নিশ্চিত যে ২০৩০-৪০ মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ অবশ্যই ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় এত বিশাল সম্পদের অধিকারী দেশে রূপান্তরিত হতে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে চলমান সম্পদবৈষম্য যাতে আর বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া এবং তা ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে চেষ্টা করা। আর সেটি নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রের সর্বাগ্র করণীয় হবে এর আর্থিক নীতিমালা ও উন্নয়ন অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন সাধন। তন্মধ্যে আর্থিক নীতিমালা-সংক্রান্ত পরিবর্তনের আওতায় ব্যাংকিং খাতে বাণিজ্যিক পেশাদারি ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা, রাজস্ব আহরণ-প্রক্রিয়ায় ‘যত সম্পদ তত কর’ ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন, কৃষি ব্যতীত অন্য সব খাত থেকে নগদ প্রণোদনা প্রত্যাহার, রাজস্ব বাজেটের আওতায় বরাদ্দ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মৌলিক প্রয়োজন ও সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকে অগ্রাধিকার প্রদান ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে।

অন্যদিকে উন্নয়ন অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখতে হবে গ্রামীণ অর্থনীতি ও অবকাঠামো এবং স্থানীয় সম্পদভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশলকে। বৈদেশিক সাহায্যকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ অভিজ্ঞতা বলে যে অধিকাংশ বৈদেশিক অর্থায়নযুক্ত প্রকল্পই এ দেশে তেমন কোনো কাজে আসেনি; বরং পরে সেগুলো জনগণের মাথার ওপর অসহনীয় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সেগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের ঘাড়ের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপানো হয়েছে। আর বৈদেশিক অনুদানপুষ্ট প্রকল্পের আওতাধীন সুযোগ-সুবিধার বেশির ভাগটাই ভাগজোখ করে খেয়েছেন আমলারা এবং ওই সব প্রকল্প থেকে জনস্বার্থ অর্জিত হয়েছে খুবই সামান্য। তবে এর চেয়েও বড় কথা, এসব প্রকল্প বিত্তবানের সম্পদ বৃদ্ধিকেই সহায়তা করে সবচেয়ে বেশি, যা সমাজে বৈষম্য সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। উদ্দেশ্যমূলক ও সন্দেহজনক মেগা প্রকল্প গ্রহণ থেকেও বিরত থাকতে হবে। কারণ, এগুলোর একটি বড় অংশের বিরুদ্ধেই দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় ও বৈদেশিক উভয়বিধ অর্থায়নে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো যাতে দুর্নীতিমুক্তভাবে দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হতে পারে, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, এসব প্রকল্পের আওতায় যন্ত্রপাতি ও অন্য যেসব দ্রব্যাদি বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, সেই আমদানি প্রক্রিয়ায়ও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

মোটকথা, যে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছি, সেখানে সম্ভাবনা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আশঙ্কাও। সম্ভাবনা এই যে তেমনটি হলে তার ফলে দেশের মানুষের আয় ও জীবনযাত্রার মান দুইই বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে আশঙ্কা এই যে অর্থনৈতিক নীতিকাঠামো ও উন্নয়ন অগ্রাধিকার পরিবর্তনের মাধ্যমে সেটিকে গণমুখী করতে না পারলে অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে তা সম্পদবৈষম্য আরও বাড়িয়ে তুলবে। এ অবস্থায় আমরা কোন পথে হাঁটব, সেটি একটি পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমরা আসলেই জানি না রাজনীতিকেরা আমাদের কোন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন—বৈষম্যের নাকি সমতার? প্রচণ্ড আশাবাদ নিয়ে আমরা তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

লেখক: আবু তাহের খান, সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ