৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে। করোনার অতিমারি সত্ত্বেও ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়েছে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশেষ দিন ও বছরে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছে। বেশির ভাগ রাষ্ট্রই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানিয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে রাজনীতির চড়াই-উতরাই পার হয়ে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক এবং উন্নয়নের নানা সূচকে যেসব বিস্ময়কর অগ্রগতি সাধন করেছে, তারও প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন ছিল এক কঠিন, সামরিক ও কূটনৈতিক যুদ্ধ অতিক্রম করে বিজয় লাভ করার ইতিহাস, একই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে শূন্য হাতে গড়ে তোলার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ, যা ৫০ বছরের পথচলায় আরেক কঠিন অর্জনের ইতিহাস। এরই মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয় এবং উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ যদি মুক্তিযুদ্ধকালের ধ্বংসযজ্ঞের শিকার না হতো, রাজনৈতিক শাসন ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন হতো, হত্যা, ক্যু ও সামরিক শাসন না ঘটত, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সৃষ্টি করা না হতো, তাহলে উন্নয়নের এই পথচলা আরও ত্বরান্বিত হতো। ৫০ বছরের পথচলার অর্ধেকের কম সময় বাংলাদেশ পরিচালিত হয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারা। সুতরাং, বাংলাদেশের ৫০ বছর এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ৫০ বছর সব সময় যেমন নিরবচ্ছিন্ন থাকেনি, তেমনি আবার প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার সুযোগও সব সময় সবার কাছ থেকে পায়নি। তারপরও আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার ইতিহাসকে এখন উন্নয়ন-সহযোগী এবং বিশ্বের উন্নত সব রাষ্ট্রই প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখছে। এটি একটি প্রেরণার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের কাছে যে দীর্ঘ বার্তা প্রেরণ করেছেন, সেটি দৃষ্টি কাড়ার মতো। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে অনেকগুলো বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা পড়ে বোঝা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের গৌরবময় দিকগুলোকে সবার দৃষ্টিতে আনার চেষ্টা করছে। তবে একই সঙ্গে সম্পর্কের কোনো কোনো পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক অবস্থানকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও তাতে আমাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। জো বাইডেন যেমন তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, ‘১৯৫৮ সাল থেকেই এই দুই দেশ শিক্ষা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। ওই সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত ৩০ দিনের এক মতবিনিময় কর্মসূচিতে অংশ নেন।’ প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তিকে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী পাকিস্তান আমলের মাঝামাঝি তথা ১৯৫৮ সাল থেকে দেখছেন, যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে টানা এক মাস যুক্তরাষ্ট্রের একটি মতবিনিময় কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করে সেই অবস্থানকেই সম্পর্কের সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার তাঁর লেখা চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধের পর দেশ পুনর্গঠনে এবং বর্তমানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে বাংলাদেশিদের কর্মশক্তি, উর্বর মস্তিষ্ক ও উদ্ভাবন গোটা বিশ্বের কাছে একটি মডেল হিসেবে কাজ করে।’
ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রে দুই দেশের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সে দেশে সফর করছে। মন্ত্রী মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তাতে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির ধারণাও ব্যক্ত করা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ মার্কিন কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সঙ্গে আগামী ৫০ বছরও সম্পর্কের উচ্চতা নির্মাণে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অংশীদারত্বমূলক নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ এবং নানা অপশক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হচ্ছে, তা মার্কিন দৃষ্টিতে যেভাবে দেখা হয়, সেটি বাংলাদেশের বাস্তবতায় বেশ ভিন্নতা রয়েছে। সে কারণেই মাঝেমধ্যে সম্পর্কের ওঠানামা, ভুল-বোঝাবুঝি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের ধারায় বিকশিত করার ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকা যেমন রয়েছে একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশগুলোরও সহযোগিতা ও সমর্থন আরও নিবিড় হওয়া প্রয়োজন। নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে মাঝেমধ্যে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অভ্যন্তরে উদীয়মান লড়াইরত গণতান্ত্রিক শক্তি; উল্লসিত হয় প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্প্রদায়িক অগণতান্ত্রিক অপশক্তি। র্যাবের কতিপয় সদস্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর দেশের অভ্যন্তরে যারা মার্কিন-বাংলাদেশ সম্পর্ক ধ্বংস হওয়ার অভিযোগ তুলেছিল, তারাই আবার জো বাইডেনের চিঠির বক্তব্য দেখে হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক তখনই উচ্চতায় উঠতে সক্ষম হবে, যখন উদারবাদী গণতান্ত্রিক শক্তি, মৌলবাদী শক্তি, সাম্প্রদায়িক জঙ্গিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করে রাষ্ট্র পরিচালনার সমর্থন ও সুযোগ পাবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসনের ধারণা কেতাবে থাকবে, বাস্তবে দূরে সরে যাবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট