২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে ব্যাপক ব্যালট জালিয়াতির অভিযোগের কারণে চার বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দেশের বিরোধী দলগুলোর পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করত বলে একটা সাধারণ ধারণা থাকলেও নির্বাচনের আগের রাতে পুলিশি প্রহরায় এবং প্রশাসনের সহযোগিতায় ব্যালট বাক্সগুলো ভরে ফেলার যে ন্যক্কারজনক ঘটনা দেশের অধিকাংশ এলাকায় ঘটানো হয়েছিল, তার সত্যতা সম্পর্কে সিংহভাগ জনগণের মনে বিশ্বাস ইতিমধ্যে দৃঢ়ভাবে গেড়ে বসেছে।
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে জাপানের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এবং বাংলাদেশ সফরে আসা মার্কিন কূটনীতিক ডোনাল্ড লু ভবিষ্যতে জালিয়াতিমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিজ নিজ দেশের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করায় ২০১৮ সালের নির্বাচনের অগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারটি আবারও সামনে চলে এসেছে। এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ যতই গলাবাজি করুক না কেন, ওয়াকিবহাল মহল ঠিকই অনুধাবন করতে পারার কথা যে ব্যাপারটা আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় বিরাট ধস নামিয়েছে, দেশের জনগণের একটি অংশের কাছে আওয়ামী লীগকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তার কিছুটা আলামত আমরা দেখলাম অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জামানত হারিয়ে চতুর্থ স্থানে পৌঁছে গেছেন, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তৃতীয় হয়েছেন। কিন্তু এই দুজনের প্রাপ্ত ভোটের যোগফল গত নির্বাচনের চেয়ে ১০ হাজার ভোট কমে গেছে। ওই নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী দ্বিতীয় হয়েছেন। আর নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির মেয়র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি এই ফলাফলকে রংপুরের ব্যতিক্রমী বাস্তবতা মনে করেন, তাহলে চরম ভুল করবেন। এটাই সারা দেশের আসল বাস্তবতা। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ, পুঁজি লুটেরা এবং পুঁজি পাচারকারীদের সহায়ক দল হিসেবে চিহ্নিত করে হয়তো অনেকেই আওয়ামী লীগের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। অতএব, আগামী সংসদ নির্বাচন যদি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু হয়, তাহলে একই রকম বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা অমূলক নয়। সময় থাকতে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ না করলে ২০২৪ সালের নির্বাচনেও জালিয়াতি করা ছাড়া তাদের জয়ের কোনো পথ খোলা থাকবে না বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ মনে করছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু গত চার বছরে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম একেবারেই ‘বাত কা বাতে’ পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে, ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচ বছর বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বিশ্ব র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করেছিল। ওই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম বছর ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ, পরের চার বছর ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপর সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমননীতি বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশ ওই ‘ন্যক্কারজনক চ্যাম্পিয়নশিপ’ থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পরিকল্পিতভাবে ওই দুর্নীতি দমন অভিযানকে গলাটিপে মেরে ফেলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করা হয়েছে। ফলে দেশে আবার দুর্নীতির তাণ্ডব পুরোদমে চালু হয়ে যায়। ২০১৪ সাল থেকে ৯ বছর ধরে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে, বিশ্ব র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ১৫টি দেশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদিও দাবি করে থাকেন যে তাঁকে কেনা যায় না, তবু সাধারণ জনগণের মনে যে বিশ্বাসটা গেড়ে বসেছে, সেটা হলো দুর্নীতির ব্যাপকতায় বর্তমান সরকারের আমল বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমল থেকে কম যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশেরই গত ১৪ বছরে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হওয়ার ব্যাপারটা তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের দৃষ্টি এড়ানো অসম্ভব ব্যাপার। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়স্বজন এবং উদার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী ও আমলারা ‘ক্ষমতার আলাদিনের চেরাগ’ পেয়ে যে প্রায় সবাই কোটিপতির কাতারে উত্তীর্ণ হয়ে গেছেন, ব্যাপারটা লুকোনোর কোনো উপায় আছে কি?
দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকটে পরিণত হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে, বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে (অথবা বিদেশে হুন্ডিওয়ালাদের কাছে বিক্রীত ডলার ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না, কিন্তু তার সমপরিমাণ টাকা হুন্ডিওয়ালাদের প্রদানের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে হুন্ডি প্রক্রিয়ায় অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে), যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থায় পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার প্রক্রিয়া। পুঁজি পাচার চাহিদার প্রধান গ্রাহক হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, সামরিক অফিসার, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণ-গ্রহীতারা। হুন্ডি প্রক্রিয়ায় যে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়ার দাবি করছে সিআইডি, তার সিংহভাগ চাহিদাকারী ওপরে উল্লিখিত গোষ্ঠীগুলো।
২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, তার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ওই সরকারের সফল দুর্নীতি দমন অভিযান। মানুষের কাছে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের জন্য চিহ্নিত হোমরাচোমরাদের ওই সময় যেভাবে নাকানি-চুবানি খেতে হয়েছিল, সেটা এখনো আমরা ভুলে যাইনি, আওয়ামী লীগের নেতাদেরও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ওই ধরনের আরেকটি অভিযান যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবিলম্বে শুরু করেন, তাহলে তাঁর নেতৃত্বে অর্জিত দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে বাস্তবায়িত মেগা প্রজেক্টগুলোর সুফল তিনি আগামী নির্বাচনে ঘরে তুলতে সক্ষম হবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি ভেবে থাকেন যে ২০১৮ সালের মতো আবারও ব্যালট জালিয়াতি বা ভোটকেন্দ্র দখল করে তাঁরা বাজিমাত করবেন, তাহলে চরম ভুল হবে। ব্যাপারটা দেশে-বিদেশে ‘আনচ্যালেঞ্জড’ যাবে না। এর ফলে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের পালে যদি হাওয়া লাগে, তাহলে আওয়ামী লীগের খবর আছে। শুধু ভারতের কৃপাধন্য হয়ে এবার সহজে পার পাওয়া যাবে না। তার মানে, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও খুনখারাবি বেড়ে যাওয়ার ‘অশনিসংকেত’ ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। সাধু সাবধান!
ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়