আজকের নারীরা যখন সর্বক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন, তখন তাঁদের প্রতি পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় এসেছে। পুরুষতন্ত্র নারীর স্বাধীনতা, সম-অধিকার, মর্যাদা কোনোটিতেই বিশ্বাসী নয়। আজকের পুরুষদের বুঝতে হবে পরিবার টিকে থাকে সম্মান ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে; নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নয়।
মানুষের জন্ম থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্বপ্ন-ভালোবাসা-আশা-হতাশা-সুখ-দুঃখ—সবকিছুই আবর্তিত হয় প্রধানত পরিবারকে ঘিরে। পরিবারে ভাঙন শুধু পরিবারকেই অস্থির করে তোলে না, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে সমাজে। ভাঙা পরিবারের শিশুরা একক বাবা-মায়ের কাছে বা কোনো অভিভাবক অথবা কোনো এতিমখানায় বেড়ে উঠতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে শিশুদের মধ্যে হতাশা ও হীনম্মন্যতার জন্ম হয়। এর পরিণতিতে আত্ম-বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত হয় তারা। তাদের সাধারণ বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। মাদকাসক্তিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে তারা।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে পারিবারিক বিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকায় ২০২০-এর চেয়ে ২০২১-এ বিচ্ছেদের পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটছে। করোনার সময়ে আর্থিক ও মানসিক নানা কারণে বিচ্ছেদ ও বাল্যবিবাহ দুটোই বেড়েছে। আদালত, গ্রাম আদালত এবং বিভিন্ন বেসরকারি আইন সেবা সংস্থায় পারিবারিক সমস্যা ও বিচ্ছেদ বিষয়ে সালিস ও মামলা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অনেক বেশি।
আমাদের মতো রাষ্ট্রব্যবস্থায় পারিবারিক বিচ্ছেদের প্রধান ভুক্তভোগী নারী ও শিশু। যদিও বিচ্ছেদের প্রভাব সমাজের সব নারীর ক্ষেত্রে সমানভাবে পড়ে না। কর্মজীবী নারীর চেয়ে গৃহিণী নারীদের মানসিক কষ্টের সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক সমস্যা। সন্তান ছোট থাকলে সেই সমস্যা আরও তীব্র হয়। আমাদের দেশের নিম্ন আদালতগুলোয় গেলেই দেখা যাবে এ ধরনের অসংখ্য ভুক্তভোগী নারী শিশুদের সঙ্গে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করেন অর্থনৈতিক ন্যায্য পাওনা বুঝে পাওয়ার আশায়।
এ দেশের সামাজিক আবহে এখন পর্যন্ত বিবাহবিচ্ছেদকে ভালো চোখে দেখা হয় না। এই বিচ্ছেদের জন্য প্রধানত নারীকেই দায়ী করা হয়। ব্যতিক্রম বাদ দিলে পারিবারিক সমস্যা দেখা দিলে নারীকেই মানিয়ে-গুছিয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়। অনেক সময় নারীকে সতিনের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে উৎসাহিত করতেও দেখা যায়। নারীর পরকীয়াকে সমাজ জঘন্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ কোনো বিবাহিত পুরুষ বহু নারীতে আসক্ত থাকলে, ‘পুরুষের ও রকম এক-আধটু চরিত্র দোষ থাকে’ বলে বিষয়টি হালকা করে দেওয়া হয়।
পরিবারে সন্তান থাকলে সন্তানের কথা ভেবে কেবলমাত্র নারীকেই সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য সব ধরনের নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে বলা হয়। এখানে পুরুষের কোনো চাপ নেই, দায়দায়িত্ব নেই।
সময়ের পরিবর্তনে এ দেশের লাখ লাখ নারী এখন কর্মজীবী। নারীর বুদ্ধি কম, হিসাব করতে জানেন না—এসব কথা এখন আর নারীর ক্ষেত্রে খাটে না। বাস্তব কারণেই যৌথ পরিবার ভেঙেছে, একক পরিবার গড়ে উঠেছে। একক পরিবারে কর্মজীবী নারীর ওপর চাপ বেড়েছে দ্বিমুখী। বাইরে আয়-রোজগারের জন্য যেতে হচ্ছে। ঘরে ফিরে ঘরকন্নাসহ সন্তানের শতভাগ দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে শরীর ও মন। একক পরিবারে পুরুষের ভূমিকা না বদলানোর কারণে ঘটছে বিপত্তি।
বিচ্ছেদের জন্য অনেকেই কর্মজীবী নারীদের অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতা থেকে সৃষ্ট স্বাধীন চিন্তাকে দায়ী করে থাকেন। একজন শিক্ষিত, স্বাবলম্বী নারী ব্যক্তিত্ববান ও আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হবেন—এটা তো স্বাভাবিক। পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রের আপত্তি থাকে সেখানেই। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ পুরুষ আয় ও আড্ডায় তাঁর কর্মঘণ্টা ব্যয় করেন। পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে আমাদের সমাজ নারী-পুরুষের কাজের যে বিভাজন পরিবারগুলোতে টেনে দিয়েছিল, তা আজও সদর্পে চর্চা হয়ে আসছে।
বিয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ ও পরিবারের প্রথা অনুযায়ী পাল্টে যেতে হয় নারীকে। পোশাক, আচরণ, পছন্দ-অপছন্দ এমনকি বাবা-মায়ের দেওয়া নাম পর্যন্ত। পুরুষকে বদলাতে হয় না কিছুই। ছোটবেলা থেকে অতিরিক্ত ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বেড়ে ওঠা পুরুষ কম ধৈর্যশীল হয়ে থাকে। নারীর কাজ, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নারীর চাহিদা—সবকিছুই পুরুষতান্ত্রিক পুরুষের কাছে উপেক্ষিত হয়।
রাষ্ট্রীয় আইন থাকার পরেও নানা অজুহাতে সমাজ ও পরিবার বাল্যবিবাহ ও পুরুষের বহুবিবাহের পক্ষে থাকায় পরিবারে ভাঙন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বহুবিবাহের বাতিকগ্রস্ত পুরুষের সংখ্যা এ সমাজে নেহাত কম নয়। একটি বিয়ে করে দু-চারটি সন্তান জন্ম দেন। তারপর বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে স্ত্রী-সন্তান ফেলে অন্য কোথাও গিয়ে পুনরায় বিয়ে করেন। এ ধরনের ঘটনার শিকার হয় সাধারণত নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো। এসব পরিবারে সচেতনতার অভাব থাকায় বিয়ের প্রস্তাব এলে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই অভিভাবকেরা কন্যাসন্তানকে বিয়ে দিয়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যেই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটায় ওই সব নারী ও শিশুসন্তানদের চরম অর্থনৈতিক ও মানসিক দৈন্যদশায় পড়তে দেখা যায়।
দীর্ঘদিন ভালোবেসে বিয়ে করে সংসার পাতার ছয় মাস-এক বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদের ঘটনাও এখন অহরহ। কেন এমন হয়? এ ক্ষেত্রে মেয়েদের কাছ থেকে যে উত্তরটি পাওয়া যায় তা হলো, বিয়ের আগের মানুষটি এবং বিয়ের পরের মানুষটি সম্পূর্ণ আলাদা। বিয়ের আগে প্রেম-ভালোবাসার সময় ধমক দিয়ে কথা বলা বা প্রেমিকার গায়ে হাত তোলার সাহস প্রেমিক পুরুষ পান না অথচ বিয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পুরুষরূপী মানুষটির পুরুষতান্ত্রিক চেতনা চাঙা হয়ে ওঠে। স্ত্রীকে নিজের সম্পত্তি ভাবতে শুরু করেন এবং তাঁর সঙ্গে যেকোনো রকম বাজে আচরণকে অন্যায় মনে করেন না।
যেসব পরিবারে নারী-পুরুষ উভয়ই পুরুষতন্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত, পরিবার ভাঙার ক্ষেত্রে তাঁদের দায়ও কম নয়। একটি মেয়ে বধূরূপে যখন নতুন একটি পরিবারে আসেন, তখন তিনি পেছনে ফেলে আসেন তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাবা-মা-ভাইবোনকে। তাঁর বেড়ে ওঠার চিরচেনা প্রকৃতি-পরিবেশ এবং বন্ধুদের; অর্থাৎ একধরনের বিচ্ছেদের মধ্য দিয়েই একজন নারী নতুন একটি অজানা স্বপ্নের পথে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে তাঁকে পদে পদে ছাড় দিয়ে আপস করে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হয়। যে নারীটি বধূরূপে নতুন পরিবারে আসেন, পরিবারের প্রত্যেকেরই তাঁর প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য বর্তায়। এ ক্ষেত্রেও ঘটে বিপত্তি। অধিকাংশ নারীকেই বিয়ের পর পরিবার-আত্মীয়স্বজন দ্বারা নানা রকম বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। শুরু হয় নানা দ্বন্দ্ব, অশান্তি এবং বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। পুরুষতন্ত্র বিশ্বাস করে স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার অধিকার স্বামীর আছে। নারীকে হেয় করা, সামান্য মানসিক নির্যাতন করা কোনো অপরাধ নয়। আজকের পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষকে এ কথা বুঝতে হবে—একজন সচেতন, স্বাবলম্বী, আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন নারী কেন তা মেনে নেবেন?
সংসার ভাঙার জন্য পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের আরেক দায় হচ্ছে—এখন পর্যন্ত পরিবারের কন্যাশিশুটিকে লেখাপড়া-নাচ-গানসহ যাবতীয় বিষয়ে দক্ষ করে তোলা হয় কেবলমাত্র ভালো ঘরে, অর্থাৎ ধনাঢ্য পরিবারে বিয়ে দেওয়ার আশায়। অনেক শিক্ষিত মাকে বলতে শুনেছি, বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়েদের বেশি বয়স করতে নেই, তাতে লাবণ্য কমে যায়। অন্যদিকে অনেক পরিবার এবং পুরুষের কম বয়সী মেয়ে পছন্দ এ জন্য যে তাকে সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মেয়ে কি পণ্য যে তা চকচকে হতে হবে! আজকের সময়ে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা মানসিক বিকারগ্রস্ততা ছাড়া আর কী হতে পারে।
আজকের নারীরা যখন সর্বক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছেন, তখন তাঁদের প্রতি পুরুষ এবং পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় এসেছে। পুরুষতন্ত্র নারীর স্বাধীনতা, সম-অধিকার, মর্যাদা কোনোটিতেই বিশ্বাসী নয়। আজকের পুরুষদের বুঝতে হবে পরিবার টিকে থাকে সম্মান ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে; নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নয়। কাজেই পরিবারের ভাঙনে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারে না। দায়িত্ববান অভিভাবকের উচিত তাঁর কন্যাসন্তানটিকে যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে উপার্জনক্ষম করে গড়ে তোলা, যাতে সে পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পারে এবং পুরুষতন্ত্রের উচিত সব ইগো এবং কুঐতিহ্য ত্যাগ করে পরিবারের প্রতি দায়িত্ববান হওয়া। তাহলেই বিচ্ছেদ কমবে, আমাদের সন্তানেরা নিরাপদে, নিশ্চিন্তে পরিবারের স্নেহ-ভালোবাসায় বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
সুতপা বেদজ্ঞ, নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী