কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে একটু অবসর মিললেই আবদুস সোবহান ভিডিও কল দিতেন স্ত্রী ইস্ফাহান সুলতানাকে। অপর প্রান্ত থেকে স্ত্রী সাড়া দিলেই সোবহানের প্রথম প্রশ্ন থাকত—‘আমার রাজকন্যা কোথায়?’ সাত মাস বয়সী মেয়ে ফাইজা রহমানের মুখটা স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই তিনি একটানা বলে চলতেন, ‘মা-মা-মা।’
রাজকন্যা আজও পুতুল খেলে, রাজ্যপাটে নেই শুধু তার রাজাটি। ফাইজার মুখে একদিন কথা ফুটবে, কিন্তু ‘বাবা’ বলে সে হয়তো কাউকে কোনো দিন ডাকতে পারবে না।
ফাইজার বাবা আবদুস সোবহান চাকরি করতেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে। ৪ জুন রাতের ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণের পর থেকে এখনো তাঁর খোঁজ মেলেনি। অজ্ঞাতনামা মরদেহের মধ্যেই কি আছে তাঁর বাবা, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে কদিন আগে নমুনা দিয়েছে ছোট্ট মেয়েটি।
সাত মাসে আর কতটুকুইবা বাবাকে চিনবে ফাইজা। তবে আদুরে হাসিতে বাবার স্নেহ আর মা ডাকের উত্তরই যেন দিত সে। শুধুই কি ফাইজা! বাবার গলার স্বর, স্পর্শ আর আদরের সব স্মৃতিই যেন নিমেষেই হারিয়ে গেছে আরও অনেক শিশুর। বাবা কী জিনিস, বোঝার আগেই যে হারিয়ে গেল তাদের বাবারা। এই দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের
বেশির ভাগই তরুণ-যুবক। নিহত হয়েছেন এমন অনেকে রেখে গেছেন আদরের ছোট্ট সন্তানকে। কারও এখনো পৃথিবীর মুখ দেখার অপেক্ষায় মায়ের গর্ভে। এখন পর্যন্ত ৪৮ জন নিহত ব্যক্তির অন্তত ১৫ জনের শিশুসন্তান রয়েছে বলে জানা গেছে। ডিপো কর্তৃপক্ষ, প্রশাসনসহ অনেকেই এখন হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের পাশে রয়েছে। কিন্তু সহযোগিতার এই হাত কত দিন থাকবে, সেটাই সবার প্রশ্ন। সহযোগিতার হাত দীর্ঘমেয়াদি না হলে অনেক শিশুর ভবিষ্যৎটাই যে নষ্ট হয়ে যাবে।
এমন দুশ্চিন্তায় আছেন রেশমা বেগম। স্বামী মোহাম্মদ শাহজাহানকে হারানোর শোক তাঁর চোখেমুখে এখনো জ্যান্ত। তবে তিন মাসের ছেলে রিহাদ আর ছয় বছরের রিহানের মুখের দিকে তাকিয়ে সামলে নিতে হচ্ছে সব। ওইটুকু বয়সের বাচ্চাদের ওপর বাবা হারানোর কষ্ট চেপে বসুক, মোটেই চান না রেশমা।
স্বামীর খোঁজে কদিন আগে নমুনা দিতে এসে রেশমা বলছিলেন, দুর্ঘটনার বীভৎসতা চিরচেনা স্বামীকেও চিনতে দিচ্ছে না। দুই শিশুকে নিয়ে কীভাবে কাটবে দিন, সেটি ভেবে এখন মনটা আরও বিষণ্ন হয়ে উঠছে।
দুর্ঘটনার পর চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৮ জুন হার মানেন মাসুদ রানা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তাঁর মেয়ে সামিয়া আর দুই বছরের ছেলে রোহানকে নিয়ে সদ্য বিধবা সুমি বেগমের সামনে এখন শুধুই অন্ধকার।
সুমি বলেন, ‘অফিসের কাজ শেষে অবসরের পুরোটা দুই ছেলেমেয়েকেই দিতেন মাসুদ। দুই সন্তানের এত কাছের, এত ভালোবাসার মানুষটা নিমেষেই স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেলেন। ওদের জীবন থেকে হঠাৎ বাবা ঝরে যাওয়ার এই নিষ্ঠুরতা কোনোভাবেই মানতে পারছি না।’
ছয় মাস বয়সী দুধের শিশু সিয়ামও জানে না, কী ঘটে গেছে তার জীবনে। আগুন নেভাতে গিয়ে নিভে গেছে তাঁর বাবা গাউসুল আজমের জীবন। গত রোববার বিকেলে গাউসুল আজমের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছার পর সবাইকে বিলাপ করতে দেখে সেই দুধের শিশু সিয়ামও কি বুঝে গেছে, বাবার উষ্ণ বুকের আসন হারিয়েছে সে?
সিয়াম, সামিয়া, রোহানসহ অনেকে তবুও নিরব-নিস্তব্ধ বাবার ঠান্ডা দেহ খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু ফাইজা, রিহাদ, রিহানসহ অনেকে কি বাবাকে শেষবারের মতো দেখতেও পাবে না? এখনো যে কোনো হদিস নেই। তাদের বাবা কি ঘুমিয়ে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফ্রিজে, নাকি মিলিয়ে গেছেন বিস্ফোরণের আগুনে! তাদের বাবারা কি তারা হয়ে গেছেন?