আমাদের দেশের সিনেমা হলগুলোয় যখন জাতীয় পতাকা প্রদর্শন করা হয়, তখন কেউ কেউ আসন থেকে উঠে দাঁড়ান না। সচেতন কেউ যখন কড়া গলায় উঠে দাঁড়াতে বলেন, তখনই কেবল দাঁড়ান। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের একটা গল্প বলে ফেলা যাক।
তখন কলকাতায় ১ নম্বর গারস্টিন প্লেসে ছিল বেতার ভবন। বেতারের সদর প্রবেশদ্বারে ২০ ফুট দীর্ঘ ও ৮ ফুট প্রস্থের প্রবেশপথটির মাঝে একটি বৃত্তের মধ্যে সিমেন্টের একটি রেখাচিত্র ছিল। সেই রেখাচিত্রটি ছিল ভারতীয় মানচিত্র। অল ইন্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর জেনারেল ছিলেন এ এস বোখারী। কলকাতা স্টেশনের ডিরেক্টর ছিলেন অশোক সেন। ১৯৩৭ সালের কোনো এক মাসের কোনো একদিন এই দুজনের আমন্ত্রণে বেতার ভবনে এলেন রবীন্দ্রনাথ।
বেতার ভবনে তখন যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সবাই কবির মর্যাদা রক্ষায় যথেষ্ট যত্নশীল ছিলেন। কবি যেন কোনোভাবে কষ্ট না পান, সেটা নিশ্চিত করার দিকেই ছিল সবার মন। কবি ঢুকলেন দরজা দিয়ে। কবিকে পথ দেখিয়ে আগে আগে হাঁটছিলেন বোখারী ও অশোক সেন। তাঁরা দুজন অনায়াসে বৃত্ত মাড়িয়ে ভারতের মানচিত্রের ওপর দিয়ে সোজাসুজি হেঁটে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বৃত্তটির সামনে এসে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন সেখানে কী আঁকা আছে। এরপর প্রশান্ত ভঙ্গিতে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে অর্ধবৃত্তাকার ঘুরে গিয়ে সামনের দিকে এগোলেন। মানচিত্রটির ওপর তাঁর পা যেন না পড়ে, সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক ছিলেন। একটু আগেই বেতারের দুই বড় অধিকর্তা মানচিত্র মাড়িয়ে গিয়েছিলেন বলে নিজেরাই লজ্জায় মাথা নত করলেন।
কবি বেতার ভবনের ভেতরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা!’... ‘মাটি’ শব্দটি আবার তিনি উচ্চারণ করলেন ধীরে ধীরে। বললেন মা-টি! যেন বলতে চাইছিলেন মায়ের অঙ্গে মাথা ঠেকানো যায়, পা ঠেকাব কেমন করে।
মাটি তখন হয়ে উঠেছিল মা-টি।
সূত্র: পঙ্কজকুমার মল্লিক, আমার যুগ আমার গান, পৃষ্ঠা ৬৪-৬৫