৬ মার্চ দুপুরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন। প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এই দেশকে রক্ষার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোটি কোটি বাসিন্দার কাছে আমার দায়িত্ব রয়েছে। তাঁরা আমার কাছে আশা করেন, আমি তাঁদের হতাশ করব না। আমি কিছুসংখ্যক লোককে কোটি কোটি নিরীহ ও নিরপরাধ পাকিস্তানির স্বদেশভূমিকে ধ্বংস করতে দেব না। পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ওপর ন্যস্ত এবং এই দায়িত্ব প্রতিপালনে তারা কখনো ব্যর্থ হয়নি।’
তিনি ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।
প্রেসিডেন্টের ভাষণের কিছুক্ষণ পরেই আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে দলটির কেন্দ্রীয় ও বাংলা দেশ শাখার ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্ত জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে। রাত পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা বৈঠকটি হওয়ার পর তা মুলতবি রাখা হয়। সভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামারুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদসহ ঢাকায় অবস্থানরত দলীয় ওয়ার্কিং কমিটির সব সদস্যই যোগদান করেছিলেন। প্রেসিডেন্টের ভাষণের ওপর বিস্তারিত আলোচনা হয় কিন্তু এই ভাষণ সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিক্রিয়া বা বৈঠকে দলীয় সিদ্ধান্ত জানতে পারেননি সাংবাদিকেরা।
কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) নুর খান লাহোরে বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসনের বৈধ অধিকার রয়েছে এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে সব বাধা অবিলম্বে দূর করতে হবে।’ তিনি ট্রেড ইউনিয়নকর্মী, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক বিরাট সমাবেশে বলেন, ‘৬ দফাসংক্রান্ত সকল বিরোধের মোটামুটি নিষ্পত্তি সম্ভব।’
গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) আসগর খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাড়িতে দেখা করেন। প্রায় চল্লিশ মিনিট তাঁরা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে আসগর খান বের হলে সাংবাদিকেরা তাঁর কাছ থেকে বৈঠকের ফলাফল জানতে চান। আসগর খান বলেন, ‘বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। শেখ সাহেব রোববারে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন।’
শনিবার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসের কর্মচারীরা বেতন পাননি, সেগুলো খোলা থাকে। সন্ধ্যা পর্যন্ত সভা-সমাবেশ চলতে থাকে। সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ বের করে এক বিশাল মশাল মিছিল। আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা বের করে শোভাযাত্রা।
বেলা আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে কয়েদিরা পালাতে গেলে পুলিশের গুলিতে ৭ জন কয়েদি নিহত ও ৩০ জন আহত হন। দরজা ভেঙে এবং পেছনের গেট টপকে তিন শর বেশি কয়েদি পালিয়ে যান।
এদিন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, একশ্রেণির দুষ্কৃতকারী ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করছে। তিনি এ ধরনের কার্যকলাপের সঙ্গে সংগঠনের সম্পর্কহীনতার কথা জোর গলায় বলেন। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কন্ট্রোল রুমে ২৪৫০০৮ নম্বরে টেলিফোন করে জানাতে অনুরোধ করেন।
ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন খাদ্য ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘খাদ্য ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের আবেদন, আপনারা নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত না করে অবিলম্বে গুদামজাতকৃত খাদ্যদ্রব্য বাজারে ছেড়ে দিন।’
এদিন এগারো দফা আন্দোলনের নায়ক, তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা ও এমএনও তোফায়েল আহমেদের নামে একটি বিবৃতি ছাপা হয় ইত্তেফাকে। তিনি রেসকোর্স থেকে শেখ মুজিবের ভাষণ সরাসরি রেডিওতে রিলে করার দাবি জানান। মূলত তোফায়েল আহমেদের নামে এই বিবৃতিটি ছাপা হলেও সেটি তৈরি করেন ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যেন শুধু রেসকোর্সে সমবেত মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং দেশের সবখানেই প্রচারিত হয়, সে কথা ভেবেই তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তোফায়েল আহমেদের নামে বিবৃতিটি ছাপান।
গ্রন্থনা: জাহীদ রেজা নূর