হোম > ছাপা সংস্করণ

জেনোসাইড নিয়ে কিছু কথা

জাহীদ রেজা নূর

বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে জেনোসাইড হয়েছিল—আন্তর্জাতিক মহল থেকে এই স্বীকৃতি যে কত বড় ব্যাপার, সে বিষয়টিকে মনে হয় আমরা খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি না। লেমকিন ইনস্টিটিউট ও জেনোসাইড ওয়াচ অল্প কয়েক দিন আগে বাংলাদেশে পাকিস্তানের ঘটানো জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেওয়ায় ১৯৭১ সালের ঘটনাবলির একটা নির্মোহ চিত্র পাবে এখন বিশ্ববাসী। আমাদের অর্জন এবং আমাদের সংগ্রাম নিয়ে ফাঁকা বুলি আওড়াতে আমাদের তুলনা নেই। কিন্তু সত্যিকারের অর্জন ও সংগ্রামে যাঁরা অংশ নিয়েছেন কিংবা যাঁরা সেই অর্জনকে মহিমান্বিত করার জন্য কোনো কাজ করেছেন, তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়ার রেওয়াজ আমাদের নেই। ফলে নানাভাবে আমরা শুধুই বর্তমান নিয়ে পড়ে থাকি। অতীতের অর্জনকে সম্বল করে বর্তমানের কাজ দিয়ে ভবিষ্যতে পৌঁছানোর চেষ্টা করি না। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।

দুই. আমি বারবার বলার চেষ্টা করেছি, জেনোসাইড আর গণহত্যা এক কথা নয়। জেনোসাইড শব্দটিকে বাংলা শব্দ হিসেবে মেনে নেওয়া হলে ভালো হয়। আমরা যেমন টেলিভিশন, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি শব্দকে বাংলা শব্দ হিসেবে গ্রহণ করেছি, জেনোসাইড শব্দটিকেও সেভাবে গ্রহণ করলে ভাষাবিষয়ক জটিলতা কমবে।

গণহত্যা শব্দের অর্থ ব্যাপকভাবে হত্যা। অনেক মানুষকে একসঙ্গে হত্যা করা। এই হত্যাকাণ্ড ছোটখাটো ঝগড়া বা এক গ্রামের দুই লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে সংঘাত থেকেও হতে পারে। কিন্তু জেনোসাইড শব্দটাই বলে দেয় যে এর সঙ্গে গোষ্ঠী বা জাতিগত হত্যাকাণ্ডের সম্পর্ক রয়েছে। গ্রিক শব্দ জেনস অর্থ গোষ্ঠী বা জাতি, লাতিন শব্দ সাইড ব্যবহৃত হয়েছে হত্যা হিসেবে। ফলে শব্দ দুটি দিয়ে মূলত বোঝানো হয় কোনো গোষ্ঠীকে হত্যা করা। সেটা ধর্মগোষ্ঠী বা বর্ণগোষ্ঠী হতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা বর্ণগোষ্ঠীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জেনোসাইডে। যুদ্ধ হলে এক দেশের সৈনিক আরেক দেশের সৈনিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হত্যা করে। কিন্তু জেনোসাইডের সময় এই হত্যা সেনাবাহিনীর পরস্পর নিধনযজ্ঞে সীমাবদ্ধ থাকে না, এখানে যথেচ্ছভাবে সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ড থেকে নারী বা শিশুও বাদ যায় না।

আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের জার্মানি কর্তৃক ইহুদি নিধনযজ্ঞের কথা জানি। একজন ইহুদিকে হত্যা করতে হলে কোনো কারণের প্রয়োজন হয়নি। মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার জন্য তার ইহুদি পরিচয়টাই যথেষ্ট ছিল। ইহুদি হলেই মরতে হবে!

বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বর এবং তাদের এদেশীয় দালাল রাজাকার-আলবদররা যখন বাঙালিদের হত্যা করেছে, তখনো অন্য কোনো পরিচয়ের দরকার ছিল না। মূলত মোটাদাগে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী, হিন্দু সম্প্রদায় কিংবা আওয়ামী লীগ সমর্থক যে কেউ হয়েছে হত্যাকাণ্ডের শিকার। পাকিস্তানিরা যে কাজটি করেছে, সেটা ছিল জাতিগোষ্ঠী নিধন। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জেনোসাইডকে দেখা না হলে জেনোসাইডের মর্ম বোঝা যাবে না।

তিন. কথাগুলো ঠিকভাবে বোঝাবার জন্য কয়েকটি উদাহরণের প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে একটি হলো, তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানিদের বাঙালিদের সম্পর্কে যে ধারণা দেওয়া হতো, সেটি ছিল একধরনের ঘৃণ্য প্রোপাগান্ডা। বাঙালিমাত্রই হিন্দু কিংবা হিন্দুর ছায়া থেকে উঠে আসা মুসলমান, ফলে বাঙালির পক্ষে আশরাফ বা অভিজাত হওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। তাদের নিচু জাতি বলে ধারণা দেওয়া হতো।

ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে বাঙালি নিধন ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। নিচু শ্রেণির মানুষকে মেরে ফেলা। রাস্তাঘাটে যেকোনো মানুষকে দেখে তাকে হত্যা করা হলে শাসকশ্রেণির কেউ তাতে বাধা দেবে না, সেটা তারা বুঝতে পেরেছিল। এ কারণেই ৯ মাসব্যাপী যে হত্যাকাণ্ড চলেছে এই ভূখণ্ডে, তা ছিল জাতি নিধন। আমাদের দেশের পোড়ামাটিটাই দরকার ছিল পাকিস্তানিদের। তারা হত্যার পর হত্যা করে বাঙালি জাতির ‘ঔদ্ধত্যের’ জবাব দিতে চেয়েছিল। আর তাই মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধ করতে একটুও বাধেনি নৃশংস পাকিস্তানিদের।

চার. বাঙালিদের ব্যাপারে কেমন ছিল পাকিস্তানি শাসক ও সেনাবাহিনীর আচরণ, সেটা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডের পাতায় পাতায় দেখা যাবে। মানুষকে তারা মানুষ হিসেবে গণ্য করেনি। কীভাবে নির্যাতন চালিয়েছে, তা পরিষ্কার হবে সেগুলো পড়লে। ঘটনার সাক্ষী কিংবা ঘটনার শিকার মানুষের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সেখানে।

সেই ঘটনাগুলোর বর্ণনা আমি এখানে দেব না, কারণ ওইটুকু কষ্ট করতে হবে সেই মানুষকে, যিনি সত্যিই আমাদের ইতিহাস এবং অর্জনকে শ্রদ্ধা করতে চান। ইতিহাসের কাছে যেতে হবে নিজেকেই। বাইরে থেকে শুধু বিষয়টির প্রতি আগ্রহী করে তোলা যায়, কিন্তু ভেতরে আগুন জ্বলে না উঠলে কেউ ইতিহাসকে সঙ্গী করে এগিয়ে যেতে পারে না।

পাঁচ. ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া জেনোসাইড বাইরের দেশের খুব কম মানুষই জানে। কোনো দেশে বেড়াতে গেলে আগ্রহী হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কিছু জানে কি না, সে বিষয়ে কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করেছি। যাদের জিজ্ঞেস করেছি, তাদের অনেকে বাংলাদেশের নামটাই শোনেনি। কেউ কেউ বলেছে, হ্যাঁ, এ রকম একটি দেশের নাম শুনেছি বটে, গত শতকের কোনো এক সময় স্বাধীন হয়েছে। কেউ আবার বলেছে, ও! সেই দেশটা, যে দেশের জাতির জনককে সেই দেশের মানুষই হত্যা করেছে?

জেনোসাইড বিষয়ে কথা বলে একজন মানুষের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। সাধারণ মানুষ কম্বোডিয়া-রুয়ান্ডার গণহত্যার কথা জানে, ভিয়েতনামে মার্কিন নৃশংসতার কথা জানে, সার্বিয়ার ঘটনা জানে, কিন্তু বাংলাদেশে এ রকম একটা ভয়াবহ জেনোসাইড ঘটে গেছে, সেই খবর রাখে না। এটা বাস্তব চিত্র। জেনোসাইড নিয়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়, সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইড স্বীকৃতি পেয়েছে?

বাংলায় গণহত্যা নিয়ে লেখালেখি করা মানুষ মনে করেন, এই রচনা দিয়েই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইডকে পরিচিত করে তোলা যাবে। এ যে কত বড় হাস্যকর ব্যাপার, সেটা তাঁরা বোঝেন না। কোনো দেশে জেনোসাইড হয়েছে কি হয়নি, সেটা শুধু মুখে বলার বিষয় নয়। এ বিষয়ে সুগভীর গবেষণা, যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণের দরকার হয়। তা নিয়ে আলোচনা হতে হয়। বিশ্বের স্কলারদের কাছে তা পৌঁছে দিতে হয়।

দুটি আন্তর্জাতিক সংগঠন অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেওয়ায় আশা করা যাচ্ছে যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সেই সব দেশের জেনোসাইড স্কলার ও ঐতিহাসিকেরা এখন এই স্বীকৃতি দেওয়ার পথ ধরে স্বীকৃতি দেবেন।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মানুষ খুব বেশি ব্যস্ত তার বর্তমান নিয়ে। এ জন্য অবশ্য সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। সামগ্রিকভাবে করোনাসহ নানা পরিস্থিতির কারণে মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরে গেছে। তা ছাড়া, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করা দেশটি আদর্শিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়েছে। নানা সময়ে নানাভাবে এই মহান অর্জনকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে এবং এই অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য নানা রকম চেষ্টা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অসাম্প্রদায়িক হয়ে বেঁচে থাকার যে অঙ্গীকার ছিল, সেটাও নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। তাই এত বড় একটি ঘটনা নীরবে-নিভৃতে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। ব্যাপক জনগোষ্ঠী নিয়ে আক্ষেপ করলে চলবে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও তার অর্জন নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের দিক থেকে অন্তত এই স্বীকৃতির যথাযথ প্রচার দরকার ছিল। দেখা যাচ্ছে, সে রকম আগ্রহ একটি মহলের মধ্যে থাকলেও অনেকেই তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হননি। তাঁরা যে এই বিশাল অর্জনকে মূল্যায়িত করছেন, এ রকম কিছু দেখার সৌভাগ্য হয়েছে খুব কম।

ছয়. এই সংগঠনগুলো থেকে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য আবেদন করেছিলেন তৌহীদ রেজা নূর। তিনি যুক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেনোসাইড নিয়ে পোস্ট ডক্টরেট করছেন। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যাঁরা জেনোসাইড নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁদের অনেকেই এখন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইড নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এর মধ্যে লিও কুপার, স্যামুয়েল টোটেন, অ্যাডাম জোনসন, গ্রেগরি স্ট্যানটন, ইরিনা ম্যাসিমিনোর কথা বলা যায়। এঁদের কেউ যুক্তরাষ্ট্রের, কেউ কানাডার, কেউ দক্ষিণ আফ্রিকার, কেউ আর্জেন্টিনার। তাঁরা এখন বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জেনোসাইডের ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন। এ রকম আরও যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

সাত. সংস্কৃতিসেবক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি মফিদুল হক লিখেছিলেন, ‘জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়’ বইটি। তিনি জেনোসাইডের স্বীকৃতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। তৌহীদ রেজা নূর আন্তর্জাতিক মহলে এ বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। তরুণ গবেষকদের মধ্যে হাসান মোরশেদ লিখেছেন ‘জেনোসাইড ৭১, তত্ত্ব, তর্ক, তথ্য’। আরও অনেকেই নিশ্চয় এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানাই।

জাহীদ রেজা নূর
উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ