এ লেখাটি আমার মাথায় ঘুরছে ১৫ বছর ধরে। তখন কাছাকাছি সময়ে কয়েকটি টেলিভিশনে চলছে সংগীত প্রতিভা খোঁজার রিয়েলিটি শো। দুর্দান্ত সব প্রতিভা বের হয়ে আসছে সারা দেশ থেকে। আমিও নিয়মিত দর্শক এসব রিয়েলিটি শোয়ের। অনেকটা মুগ্ধ বলতে পারেন। একটাই বিরক্তি ছিল, যখন প্রতিভা প্রকাশ শেষে একজন প্রতিযোগী অনুনয়-বিনয় করে বলত, ‘আমার গান ভালো লাগলে প্লিজ, আমাকে এসএমএস করুন।’ একজন শিল্পীর এই বাণিজ্যিক আবেদনে রীতিমতো বিব্রত লাগত।
প্রথম দিকে আমি তাদের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ ছিলাম যে তাদের আকুতিতে মাঝেমধ্যে সাড়া দিতাম। কিন্তু যখন দেখলাম একজন প্রতিযোগীকে ভোট করতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, দেয়াললিখন ও মাইকিং চলছে। একপর্যায়ে দেখলাম বলা হচ্ছে, আপনার পছন্দের প্রতিযোগীকে যত খুশি তত এসএমএস করতে পারবেন। তার মানে প্রতিযোগীর বাবার টাকা থাকলে তিনি ফল নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিতে পারবেন। আর তখন মনে হলো শিল্পের এই প্রতিযোগিতাটা আর শ্লীল পর্যায়ে নেই। যে কারণে ওই সব রিয়েলিটি শো থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম।
এবার মার্চেও মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজাকে স্বাধীনতা পদক দেওয়া নিয়ে বিব্রত হয়েছিলাম। তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক দেওয়া হলো এবং তা আবার ফিরিয়েও নেওয়া হলো। বিব্রত না হয়ে উপায় কী? আমির হামজা পদক পাওয়ার যোগ্য কি যোগ্য নন, সেটা আমার কাছে মুখ্য ছিল না। আমার কাছে মুখ্য, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার অপমান। অথচ তিনি নিজে পুরস্কার চাননি। তখন একবার লিখতে চেয়েছিলাম, আমি বলতে চাইছিলাম, এভাবে পদক পেলেই কী আর না পেলেই কী?
স্বাধীনতা পদকসহ অন্যান্য জাতীয় পদক নিয়ে অনিয়মের গল্পগুলো মোটেও নতুন নয়। শুধু জাতীয় পদকই-বা বলি কেন, যেকোনো পদক বা স্বীকৃতি নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা আমাদের খুবই পুরোনো অপসংস্কৃতি। যাঁরা এই চর্চা করেন, দোষ কিন্তু তাঁদের নয়। মূল কারণ, অযোগ্য লোককে যোগ্যতার স্বীকৃতি দেওয়া। আমাদের দেশে এখন ছয়টি জাতীয় পদক দেওয়া হয়। যাঁরা পদক পান, তাঁরা বেশির ভাগই যোগ্য। কিন্তু এর মধ্যে দু-একজন চোখে লাগার মতো অযোগ্য লোক ঢুকে যান। আর এতেই গোটা প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
কিছুদিন আগে যখন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার দেওয়া হলো, তখন সমালোচনা হলো আরেক দফা। বেশ কড়া এবং যৌক্তিক সমালোচনা। আর এবার যে প্রশ্নটি বারবার উঠে এল, সেটা হচ্ছে—একজন গুণী মানুষকে কেন আবেদন করে পদক নিতে হবে? আমার কাছে এ প্রশ্নটি ১৫ বছরের পুরোনো। লেখার শুরুতে রিয়েলিটি শোতে শিল্পীর এসএমএস চাওয়ার কথা বলেছিলাম। পক্ষে এসএমএস চাওয়া এবং পদকের আবেদন করার বিষয়টি আমার কাছে একই রকম মনে হয়।
এই পর্যায়ে একটি গল্প বলি। বছর চারেক আগে হঠাৎ আমার ফোনে এক অপরিচিত নম্বরের ফোন, ‘ভাই, আপনাকে আমরা সাংবাদিকতায় পদক দিতে চাই।’ পদকটি জাতীয় নয়, কিন্তু মোটামুটি পরিচিত। বললাম, ‘আমি তো আবেদন করিনি।’ তিনি বললেন, ‘গুণীদের আবেদন করে পুরস্কার নিতে হয় না। আমরা তাঁদের খুঁজে বের করি।’ যদিও আমিই আমার গুণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না! তবু বেশ গদগদ হচ্ছিলাম। কিন্তু পরের বাক্যটিতেই সব উত্তেজনা জল হয়ে গেল। কারণ তিনি বললেন, ‘ভাই, শুধু এবার নয়, প্রতিবার আপনি যাঁকে বলবেন আমরা তাঁকেই চোখ বন্ধ করে পদক দেব। আপনি শুধু আমার ইভেন্টের প্রচারটা দেখবেন।’
সেদিন লোকটার প্রস্তাব অশ্লীল মনে হলেও একটা কথা খুব মনে ধরেছিল। যিনি পুরস্কার চান, তাঁকে আবেদন করতে হবে কেন? গুণী কেন বলতে যাবেন আমি গুণী, স্বীকৃতি দাও? আমার ব্যক্তিগত মত, নিজের গুণের বিবরণ দিয়ে ওই আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গুণপনার আওতা এক ধাপ ছোট হয়। এ নেহাত আমার ব্যক্তিগত মত। যাঁরা আবেদন করে পদক পান বা পেয়েছেন, তাঁদের কিন্তু আমি কটাক্ষ করছি না। আমি বলতে চাইছি, পদ্ধতিটা এমন কেন? গুণী মানুষ খুঁজে বের করার দায় কেন পুরস্কার কর্তৃপক্ষ নেবে না? গুণীর কদর না হলে ভালো কাজ করতে মানুষ উৎসাহ পাবে কেন? কেন গুণীকে স্মারক জমা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে?
ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন মানুষকে চিনি, যিনি সাড়ে চার শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি কখনোই জাতীয় পদকের ধারেকাছে যাননি। এরই মধ্যে পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর সন্তানেরাও কখনো বাবার পদকের জন্য হাহাকার করেননি। আর এক পদকপ্রাপ্তের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। তিনি প্রথম দুটি জাতীয় পদকই পেয়েছেন। একবার সেই ভদ্রলোক এক টেলিভিশনে কথা বলতে গেলেন। অন্য অতিথিদের দেখলেন। তারপর বললেন, ‘এ কাদের নিয়ে এসেছেন? এরা কেউ আমার লেভেলের না।’ পাঠক ভাবুন, কখনো কখনো এমন মানসিকতার লোকজন জাতীয় পুরস্কার পেয়ে যান। যাঁরা মনের মধ্যে মানুষের শ্রেণি বিভাজনের বিষ নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি খুব পরিচিত উক্তি মনে পড়ছে, ‘যে জাতি গুণীর কদর করে না, সে জাতির মধ্যে গুণীর জন্ম হয় না।’ কিন্তু আমাদের জাতি তো গুণীর কদর করতে চায়। ৮ বছরের জাতীয় ক্রীড়া পদক একসঙ্গে দেওয়া তো হলো। সমস্যা হচ্ছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অযোগ্য লোক নিজেকে নানা কসরত করে যোগ্য বানালেন এবং যোগ্য মানুষের ভিড়ে মিশে গেলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পদক নিতে কেন এত হাহাকার? কী হবে দৌড়ঝাঁপ করে পদক নিয়ে? সে রকম লাভ আমি দেখি না। সামাজিক একটা পরিচিতি পাওয়া যায় হয়তো, কিন্তু প্রকৃত গুণী যিনি, তাঁর কি এই পরিচিতির দরকার আছে?
পরিচয় ভাঙিয়ে আরও সরকারি সুবিধা যাঁদের দরকার, তাঁরাই মূলত পদকের দৌড়ঝাঁপে অংশ নেন। এটা আমার খুব সাধারণ পর্যবেক্ষণ। উদাহরণ দিয়ে হয়তো বলা যেত। ইচ্ছে করেই বললাম না। কিন্তু আবারও বলছি, যাঁরা পদক পাচ্ছেন, তাঁরা বেশির ভাগই যোগ্য। অন্তত তাঁদের বাঁচাতে পদক দেওয়ার কাজটি আরেকটু খেটেখুটে করা দরকার।
যেকোনো পদক দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের একটি সার্চ কমিটি থাকা উচিত। একই সঙ্গে সারা দেশের যেকোনো মানুষের নাম প্রস্তাব করার সুযোগ থাকা উচিত। আর যাঁরা নিজেদের যোগ্য মনে করেন, তাঁদের আবেদন করার পথটিও বন্ধ করা উচিত নয়। এরপর বিচার-বিশ্লেষণ করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত রায় হওয়া উচিত। শুধু জাতীয় পদক কেন, যেকোনো পদক বা স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও তা-ই হওয়া উচিত। পদক কর্তৃপক্ষের মনে রাখা দরকার, স্বীকৃতির জন্য হয়তো বহু মানুষ আবেদন করেন। কিন্তু আবেদন করে স্বীকৃতি নেওয়ায় বিশ্বাসী নন, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম নয়।
পলাশ আহসান, যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন