খুলনা জেলার ডুমুরিয়ার একটি ছোট্ট গ্রাম চুকনগর। ভদ্রা নদীর তীরে এই গ্রামে প্রলয় নেমে এসেছিল একাত্তরের একদিন। ২০ মে, বৃহস্পতিবার, সকাল ১০টা। ঘড়ির কাঁটা তখনো সচল। হাজার হাজার মানুষের পদভারে চুকনগরের মাটি ভারাক্রান্ত, কিন্তু প্রতিবাদহীন। মাটিই তো মাটির মানুষের শেষ ঠিকানা, মাটিতেই মিশে যায় নশ্বর দেহ।
কেন এত মানুষ সমবেত হয়েছিল চুকনগরে? ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ গণহত্যা আরম্ভ করলে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। হানাদারদের মোকাবিলায় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরতা, নৃশংসতার মাত্রাও বাড়তে থাকে। শুধু ঢাকা বা অন্য বড় শহরে নয়, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের মতো ঘটনা বিস্তৃত হতে থাকে সারা দেশে। জীবন বাঁচাতে নিরস্ত্র অসহায় মানুষ ছুটতে থাকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তার অভাব বোধ করে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়া শুরু হয়। ফলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ছিল নৈমিত্তিক ঘটনা। ভারতীয় সীমান্তের কাছে অবস্থিত খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত এমনি এক স্থান চুকনগর। ভৌগোলিক কারণে ১৯৭১ সালে এই চুকনগর বাজার অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তিন দিকে নদী ঘেরা চুকনগর থেকে ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারলেই জীবন নিরাপদ! যশোর, খুলনা এবং সাতক্ষীরার সংযোগস্থল হওয়ায় চুকনগরে জনসমাগম ছিল বেশি।
নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আপন বসত ছেড়ে কত কত দূর গ্রাম-জনপদের শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-জোয়ান-তরুণ সব বয়সী মানুষ ভয়ার্ত চোখে খুঁজছিল পালানোর পথ। উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়ে খুঁজছিল বাঁচার ঠিকানা। হেঁটে, নদীপথে রাতের আঁধারে সমবেত হয়েছিল চুকনগরের নিরিবিলি শান্ত ভদ্রা তটে। কত ছিল সংখ্যায় তারা? পিঁপড়ের সার দেওয়া মানুষের মাথা গোনা ছিল নিষ্প্রয়োজন। পাকিস্তানি হার্মাদ সেনারা ট্রাক ভরে এসে ছোটায় বুলেটবৃষ্টি অসহায় মানুষের বুকে। বাঁচার জন্য ঘরছাড়া মানুষেরা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে হাজারে হাজার। মাতৃস্তনে মুখ রাখা ছয় মাসের শিশু অসহায় তাকিয়ে দেখে রক্তে ভেজা মায়ের বুক।
২০ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত টানা চার দিন লাশ সরানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ৪২ জনের একটি দল। সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, ২৪ তারিখ দুপুর পর্যন্ত চার হাজার লাশ গুনে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেন তাঁরা। এই গণনার মধ্যে নদী, পুকুর, ডোবা, জলায় ভাসমান হাজার হাজার লাশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ ভিয়েতনাম যুদ্ধে একসঙ্গে কয়েক শ মানুষ হত্যার বিষয়টি অনেক বড় গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত। কিন্তু চুকনগরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তা তুলনীয় নয়।
একাত্তর ছিল মুক্তির কাল, একাত্তর ছিল ঘাতকের সময়, আবার একাত্তরই ছিল প্রতিরোধ, সাহস আর বিজয়ের সমবেত জয়ধ্বনি। একাত্তর ছিল আলো এবং অন্ধকারের সমবেত খেলা। একাত্তরে মৃত্যুর মিছিল থেকে জীবনের আয়োজন করেছে বাঙালি। যাঁদের রক্তে আজ আমাদের এই স্বাধীনতা, তাঁরা আজ নাম-পরিচয়হীন, স্মৃতির মিনার।
চুকনগরের হাজার হাজার শহীদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে নত শিরে দাঁড়িয়ে আমরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি না, একাত্তরে আমরা হারিনি। এখন এবং ভবিষ্যতেও আমরা হারব না?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা