মন নিয়ে কথা বলা আমার জন্য কঠিন। তারপরও দ্বিধা নিয়েই দুয়েকটি কথা এখানে লিখছি। প্রথমেই সিগমন্ড ফ্রয়েড থেকে ধার করছি। একবার এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, এই মুহূর্তে তিনি কী নিয়ে কাজ করছেন? উত্তরে সাংবাদিক মহোদয়কে তিনি যা বলেছিলেন, সেসব কথা সুন্দরভাবে লেখক ও অনুবাদক শাহাদুজ্জামান ভাষান্তর করেছেন: ফ্রয়েড বলছেন, ‘সাধারণ মানুষ, যাঁরা মনের বিচার-বিশ্লেষণ নিয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের পক্ষে একটি লেখা লিখছি। চিকিৎসকেরা লাইসেন্সপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য কাউকে এ বিষয় নিয়ে কাজ করতে দিতে চান না। তাঁদের স্বভাব এমনই। যেকোনো নতুন আবিষ্কারকদের প্রচণ্ড বাধা দেবেন। শেষে ওটার ওপরই একচেটিয়া দখল নিতে চাইবেন।’
আদতে কথা হলো, মানুষের মনকে চিহ্নিত করা, এই মনের আকার-প্রকার খুঁজে বের করা সম্ভবত পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর মধ্যে একটি। মানুষের মন বোঝা শুধু কঠিন নয়; বরং নিজের মন নিয়েও মানুষের ত্রাহি অবস্থা হতে পারে। গানে গানে এই কঠিনের প্রকাশ সহজ হবে। ‘মনকে আমার যত চাইরে বুঝাইতে/ মন আমার চায় রঙের ঘোড়া দৌড়াইতে/ পাগল মন মন রে/ মন কেন এত কথা বলে [...]’।
আমরা অনেক সময় মনের বিরুদ্ধাচরণ করি। মনের বিরুদ্ধে কাজ করি। মনের কথাকে আমলে নিই না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া যায় না। এমনটি কেন হয়? মন আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে নাকি আমরা মনকে নিয়ন্ত্রণ করি? আমরা হৃদয়ের চাওয়াটাকে সব সময় প্রাধান্য দিতে পারি না। হৃদয়ের চাওয়া বাস্তবায়ন করতে না পারার পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। কোথাও কোথাও সামাজিক রীতি-নীতি, প্রচলিত নিময়, শিষ্টাচার, ধর্মীয় বিধিবিধান, প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত ধারণা মনের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। আমার কোন দিকে যাওয়া উচিত? আমি আমার মনের পক্ষে দাঁড়াব? না সমাজ ও প্রচলিত বাস্তবতার পক্ষে? কখনো মনে হতে পারে সমাজ, ধর্ম ও প্রচলিত বিধিবিধান—সব এক জোট হয়ে আমার বিরুদ্ধে লড়ছে। এগুলো নিয়ে বিশদ করে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। সব প্রশ্নের মীমাংসা হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সারা জীবন ধরেও যদি কিছু প্রশ্ন আমাদের কাছে অমীমাংসিত থেকেও যায়, তাতেও হয়তো ক্ষতি নেই।
তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ছাড়াও আমরা বলতে পারি, যে মন সময় ও প্রগতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সেটি উন্নয়নশীল মন। যে মন একটি বিশেষ গণ্ডিতে বন্দী, তাকে আমরা বলি রুদ্ধ মন। আপনারা ইংরেজিতে যাকে গ্রোথ মাইন্ডসেট ও ফিক্সড মাইন্ডসেট বলে সম্বোধন করে থাকেন।
আপনার-আমার মন কোন ভাগে? বুঝব কী করে? ভালো-মন্দ যা-ই ঘটুক দিন শেষে আপনি যদি অন্যের কথা, কাজ ও মতামতকে কোনোভাবেই গ্রহণ করতে না পারেন, তবে আপনার মনটি এখনো রুদ্ধ হৃদয়ের দলে। আর আপনি যদি নৈর্ব্যক্তিক একটি অবস্থান থেকে নিজেকে দেখতে পারেন, নিজের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি অন্যের মতামতকেও মূল্য দিতে পারেন, ভেবে দেখেন, প্রয়োজন অনুসারে গ্রহণ ও বর্জন করতে জানেন, তবে আপনার মনটিই উন্নয়নশীল মন।
ভারতবর্ষের দার্শনিক সংঘে উপস্থিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার সভাপতির ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলেছেন: ‘লোকশিক্ষার যে আশ্চর্য প্রণালি বহুকাল ধরে চলে আসছে তা সমস্ত বিকাশের মূল; কিন্তু তা আজ ধ্বংসোন্মুখ। আমাদের প্রাক্তন বিদ্যায়তনগুলোতে দলে দলে ছাত্ররা নানা দেশ থেকে এসে প্রসিদ্ধ অধ্যাপক ও আর্যগণের চারদিকে সমবেত হতো। সেই শিক্ষাসূত্রগুলো গভীর ও স্থিরসলিল হ্রদের মতো; সেখানে আসতে হলে দুর্গম পথ অতিবাহন করতে হয়। কিন্তু সেই সব জলাশয় হতে প্রতিনিয়ত বাষ্পোদগম হয়ে যে সব মেঘ জন্মাত, তা বায়ুভরে কত প্রান্তরে পর্বত উপত্যকার ওপর দিয়ে সমগ্র দেশে পরিব্যাপ্ত হতো।’
আমাদের জানা প্রয়োজন কেন আমরা পড়াশোনা করছি? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি? কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে থেকে, কীভাবে শুরু হলো? আমরা যা পড়ছি, যেভাবে পড়ছি, যা করছি সব ঠিকঠাক আছে তো? নাকি শ্রম, সময় ও অর্থের অপচয়! দ্রুত হিসাব করা জরুরি। চলুন, আমরা আমাদের সময়, শ্রম ও অর্থকে অর্থপূর্ণ করি। রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র বলেছেন, ‘সুশিক্ষার লক্ষণ হলো এই যে, তা মানুষকে অভিভূত করে না, মানুষকে মুক্তিদান করে।’ আহমদ ছফা লিখেছেন বাঙালি মুসলমানের মন নিয়ে। আমরা পড়ে দেখতে পারি। জাতিগতভাবে আমাদের বেড়ে ওঠা নিয়ে সুন্দর ও যুক্তিপূর্ণ আলাপের সন্ধান পাওয়া যাবে।
তবে হাল আমলের চল হলো, চোখ-মুখ বন্ধ করে ফিক্সড মাইন্ডসেটকে বকাঝকা করা। একটি কথা মনে রাখা কর্তব্য—যাকে আমরা ফিক্সড মাইন্ডসেট বলে চিহ্নিত করি, সেটি আসলে সব সময় খারাপ মাইন্ডসেট নয়। কোথাও কোথাও ফিক্সড থাকা জরুরি।
বিখ্যাত বাঙালি গায়েন প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। ‘আলু বেচো, ছোলা বেচো, বেচো মটরদানা, বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না...’। আগেই বলা হয়েছে, ফিক্সড মাইন্ডসেট সব সময় খারাপ না। দেখুন, আপনি যদি আপনার চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তির ওপরে অটল থাকেন, যদি বলতে পারেন, আমি আমার স্বপ্ন বিক্রি করব না। আপনি যদি আপনার স্বপ্নের পরিচর্যা করেন, তাহলে আপনাকে রুখতে পারে এমন সাধ্য কার আছে! এখানে আপনি নিজের স্বপ্নে ফিক্সড থাকুন! যদি বলতে পারেন, আমি করপোরেটের দাস হব না। আমার চিন্তা, ভাবনা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে আমি যেনতেনভাবে করপোরেট পুঁজির পাহাড় গড়ার কাজে খরচ করতে পারি না। আপনি যদি এমন একটি মাইন্ডসেট তৈরি করতে পারেন, তখন লোকে যদি তাকে ফিক্সড মাইন্ডসেট বলে গালিও দেয়, তখন অনেককেই পাবেন সেই ফিক্সড মাইন্ডসেটের দলে। যে মন উদারনৈতিক চিন্তা করতে পারে, যে মন এক লহমায় ঘুরে আসতে পারে উদারগৈরিক মাঠ—কে তাকে তুচ্ছ করে? কে তাকে সংকীর্ণ বলে গালি দেয়? কবি কাজী নজরুলের মতো করে তখন বলতে হবে, ‘কূপমণ্ডূক অসংযমীর আখ্যা দিয়াছো যারে, তারি তরে ভাই, গান রচে যাই, বন্দনা করি তারে...’।
আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় একটি ফিচার পড়েছিলাম। বাবা দিবসে এক কন্যা তাঁর বাবাকে নিয়ে লিখেছিলেন ফিচারটি। লেখকের বয়ানটি অনেকটা এমন, ‘আমার বাবা একজন এক্সট্রা অরডিনারি মানুষ ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর জীবনের এক্সট্রাটুকু বিক্রি করে দিয়েছিলেন অরডিনারি বিষয়াদি ম্যানেজ করতে।’ এই যেমন মনে করুন, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ কিনতে। জীবন অনেক দামি বিষয়। আপনি এই জীবনটি পেয়েছেন, আপনি অনেক ভাগ্যবান। লালন ফকিরের গানে আছে, ‘লক্ষ জনম ঘুরে ঘুরে পেয়েছি এই মানব জনম...’। আবার বলেছেন, ‘দেবদেবতাগণ করে আরাধন জন্ম নিতে মানবে...’। নিজেকে মূল্য দিন, কে আপনাকে মূল্য দিল বা দিল না, তা অত বেশি আমলে নেবেন না। কারও পাত্তা দেওয়া বা না দেওয়ায় জীবনের তেমন লাভ-ক্ষতি নেই। যেহেতু জীবন একটি বড় বিষয়, অতএব জীবনকে যেনতেনভাবে খরচ করে ফেলা ঠিক হবে না।
লেখক: মুহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, শিক্ষক, জেনারেল এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি