ঢাকার পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে একের পর এক খারাপ সংবাদ আসছে। দেশি-বিদেশি নানা গবেষণায় উঠে আসছে ঢাকার পরিবেশদূষণের খবর। সবশেষ চলতি মাসে প্রকাশিত এক গবেষণায় ঢাকার ২৫টি এলাকাকে ‘হট স্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, জার্মান রেডক্রস ও বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর যৌথভাবে এই গবেষণা চালায়। ঢাকা শহরের দাবদাহ নিয়ে ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি অন হিট ওয়েভ ইন ঢাকা’ শীর্ষক এই গবেষণায় ঢাকার ২৫টি অত্যধিক গরম এলাকার নাম উঠে আসে।
গবেষণায় উঠে আসা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হচ্ছে বাড্ডা, গুলশান, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, গাবতলী, গোড়ান, বাসাবো, টঙ্গী, শহীদনগর, বাবুবাজার, পোস্তগোলা, জুরাইন, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, কুর্মিটোলা, আজমপুর, উত্তরা, কামারপাড়া, মোহাম্মদিয়া হাউজিং, আদাবর, ফার্মগেট, তেজকুনিপাড়া, নাখালপাড়া ও মহাখালী।
ঢাকা নিয়ে এমন খবর নতুন নয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বের ৬০টি নির্মল শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল তলানিতে। শহরের স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক এই তালিকা প্রকাশ করে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। সেখানে ঢাকার অবস্থান ৫৪ নম্বরে। ২০১৯ সালে এই তালিকায় ঢাকা ছিল ৫৬ নম্বরে।
ঢাকার এই পরিস্থিতির পেছনে মূল কারণ দূষণ। জলজ পরিসর কমে যাওয়া, বায়ুদূষণ বাড়া ও ব্যাপক জনঘনত্ব—এসব মিলিয়েই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউটের (ইপিআইসি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে ঢাকার বায়ুদূষণের যে অবস্থার কথা বলা হয়, তা রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। সেখানে বলা হয়, বায়ুদূষণের কারণে ঢাকাবাসীর গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর ৭ মাস। গবেষণায় বলা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী ঢাকার বাতাস অন্তত ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি দূষিত। এই দূষণ বাড়ে শীতের সময়।
বাংলাদেশের গবেষকেরা বলছেন, দেশি-বিদেশি নানা গবেষণা বিশেষজ্ঞদের ভাবিয়ে তুললেও সরকারের টনক নড়ছে না। ঢাকার দাবদাহ কমাতে বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পরিবেশ ও দূষণ গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, ঢাকার ওপর চাপ কমিয়ে এই শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরের বাসা ও অফিসে এসির ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এর বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কাচের গ্লাসসমৃদ্ধ ভবনের অনুমতি বাতিল করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে আধুনিক গণপরিবহন বাড়াতে হবে। শহরে খালি জায়গা বাড়াতে হবে। বন ও জলাশয় ধ্বংস থেকে বিরত থাকতে হবে।
এই শহরের ইকোসিস্টেম ধ্বংসের শেষ পর্যায় চলে এসেছে উল্লেখ করে ঢাকাকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় এখন পর্যন্ত টেকসই কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশ। স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এই পরিচালক বলেন, ক্যাপসের এক গবেষণায় দেখা গেছে করোনাকালে সার্কভুক্ত দেশের রাজধানীর মধ্যে ঢাকার দূষণ সবচেয়ে বেশি ছিল।
ঢাকার পরিবেশ দূষণ কমাতে ২০১৯ সালে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় নির্মল বায়ু বিধিমালা করার কথা থাকলেও ২০২১ সালেও তা করতে পারেনি। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন বলছেন, এ বছরই তাঁরা বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা করতে যাচ্ছেন। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, বিধিমালাটি বর্তমানে খসড়া আকারে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যাচাই-বাছাই চলছে। এই বিধিমালা ঢাকার দূষণ কমাতে সহায়তা করবে। আইন অমান্যকারীদের সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকবে। বায়ুর মান রক্ষায় যারা ভূমিকা রাখবে, তাদের পুরস্কৃত করা হবে। এতে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ভবন নির্মাণকাজ, ইট ভাটা, ফিটনেসবিহীন গাড়ির ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা থাকবে।