দুই দিনে রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে চারটি ভূমিকম্প হয়ে গেল। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটি ১০ জনের প্রাণহানি ঘটিয়েছে। উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদীর ঘোড়াশালে। আর আজ সকাল ও সন্ধ্যায় তিন দফায় মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে, ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায়। এগুলোর মাত্রা রিখটার স্কেলে ৫ এর নিচে ছিল। লক্ষ্যণীয় হলো— এই ভূমিকম্পগুলোর সবকটির গভীরতা ১০ কিলোমিটার।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, ১০ কিলোমিটার ভূমিকম্পের সাধারণ গভীরতা। এটিকে ‘নির্ধারিত গভীরতা’ হিসেবে ধরা হয়। অনেক সময় ভূমিকম্পের তথ্য এতটাই অপর্যাপ্ত হয় যে, সঠিক গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। তখন ভূমিকম্পের গভীরতাকে ১০ কিলোমিটার ধরা হয়। কিন্তু কেন?
ভূমিকম্পের সাধারণ গভীরতা ১০ কিলোমিটার কেন
পৃথিবীর নানা অঞ্চলের ভূমিকম্পের নির্ভরযোগ্য ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ভূমিকম্পের অধিকাংশই প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে ঘটেছে। কোনো অঞ্চলের ভূকম্পনের গভীরতার নির্ভরতার হিসাব নিয়ে হিস্টোগ্রাম তৈরি করলে দেখা যাবে, ১০ কিলোমিটার সর্বোচ্চ শিখরে থাকবে। সেকারণে গভীরতা জানা না থাকলে ১০ কিলোমিটারকে যুক্তিসঙ্গত গভীরতা হিসেবে দেখা হয়।
ইউএসজিএস আগে ৩৩ কিলোমিটারকে নির্ধারিত গভীরতা হিসেবে ধরত। কিন্তু আধুনিক গবেষণার তথ্য বলে, ১০ কিলোমিটারই বেশি বাস্তবসম্মত। তবে সাবডাকশন জোনসহ কিছু অঞ্চলে অনেক ভূমিকম্প ১০ কিলোমিটারেরও বহু গভীরে ঘটে। সেসব জায়গায় বাড়তি গভীরতা নির্ধারণ বেশি যৌক্তিক। সাবডাকশন জোন হলো এমন এলাকা, যেখানে পৃথিবীর দুটি টেকটোনিক প্লেট পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং একটি অন্যটির নিচে ঢুকে পড়ে বা নেমে যায়।
গভীরতা নির্ধারণের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো— ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রের কাছাকাছি পর্যাপ্ত সিসমিক স্টেশন না থাকা। সাধারণ নিয়ম হলো— ভূমিকম্পের গভীরতা নির্ভুলভাবে জানতে হলে উপকেন্দ্র থেকে নিকটতম সিসমিক স্টেশনের দূরত্ব ও ভূমিকম্পের গভীরতার চেয়ে কম হতে হবে।
আধুনিক কম্পিউটিং ও তাত্ত্বিক উন্নতির কারণে এখন অনেক ক্ষেত্রে দূরের স্টেশন থেকেও গভীরতা নির্ণয় করা সম্ভব। তবুও বাস্তব নিয়ম হচ্ছে— ভূমিকম্প পরিমাপে নির্ধারিত গভীরতা ধরার ঘটনা অগভীর ভূমিকম্পের বেশি ঘটে, গভীর ভূমিকম্পে নয়।
ইউএসজিএসের সাম্প্রতিক নির্দেশনা বলছে, বিশ্বজুড়ে প্রচুর ছোট ও অগভীর ভূমিকম্পের নির্ভরযোগ্য গভীরতা নির্ণয় করা যায় না। বিশেষ করে যখন নিকটতম সিসমিক স্টেশন ভূমিকম্পের উৎসবিন্দু থেকে অনেক দূরে থাকে। তখন কম্পিউটার অ্যালগরিদম ডিফল্ট গভীরতা ১০ কিলোমিটার ধরে নেয়। অতীতে ৩৩ কিলোমিটার ব্যবহৃত হলেও গবেষণায় দেখায় গেছে, বেশিরভাগ অগভীর ভূমিকম্পের গড় গভীরতা ৮–১২ কিলোমিটার। সেই কারণে এখন ১০ কিলোমিটারকেই সাধারণ মান হিসেবে ধরা হয়।
কেন নির্ভরযোগ্য গভীরতা নির্ধারণ করা কঠিন
ভূমিকম্পের গভীরতা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন হয় অন্তত তিন দিক থেকে শক্তিশালী সিসমিক সিগনাল। সিসমোলজিস্ট বা ভূকম্পবিদদের অনুসৃত নীতি হচ্ছে, যদি নিকটতম সিসমিক স্টেশন ভূমিকম্পের প্রকৃত গভীরতার চেয়ে দূরে থাকে, তাহলে নির্ভরযোগ্য ফল পাওয়া কঠিন।
এ কারণে—
ছোট মাত্রার কম্পন হলে সিগনাল দুর্বল হয়।
দূরবর্তী স্টেশনগুলোতে কম্পন পৌঁছায় বিকৃতভাবে।
অ্যালগরিদম সঠিক গভীরতা গণনা করতে ব্যর্থ হয়।
ফলে অনেক ছোট বা স্থানীয় ভূমিকম্পে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ১০ কিমি গভীরতা দেখা যায়।
ঢাকার মতো সিসমিক অবজার্ভেশন স্টেশন কম থাকা এলাকায় এই নির্ধারিত গভীরতা ঘন ঘন দেখা যায়।
তাহলে প্রকৃত ভূমিকম্পগুলো ১০ কিলোমিটার গভীরে?
সবসময় না। ভূমিকম্পের বাস্তব গভীরতা ০ থেকে ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে পৃথিবীর ভূত্বক সাধারণত ৫–৭০ কিমি পুরু, এবং তার মধ্যে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ ভূমিকম্পই অগভীর ভূমিকম্প, যার গভীরতা সাধারণত ০–৭০ কিলোমিটার।
এর মধ্যে—
০–২০ কিমি → সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প
২০–৭০ কিমি → মাঝারি গভীরতার
৭০ কিমির বেশি → সাবডাকশন জোনে দুর্লভ গভীর ভূমিকম্প
অতএব, ১০ কিলোমিটার বাস্তবে একটি সাধারণ অগভীর সিসমিক স্তর হলেও, ডেটা শতভাগ নির্ভুল না হলে এটি অ্যালগরিদমিক অনুমানও হতে পারে।
অগভীর ভূমিকম্পের প্রভাব
যখন ভূমিকম্পের উৎসবিন্দু মাটির কাছাকাছি—মাত্র ১০ কিলোমিটার গভীরে—তখন তার কম্পন খুব দ্রুত পৃষ্ঠে পৌঁছে।
এর ফলে—
১. ঝাঁকুনি বেশি তীব্র হয়। একই মাত্রার ভূমিকম্প যদি ১০ কিমিতে হয়, তার কাঁপুনি ৫০ কিমি গভীরতায় হওয়া ভূমিকম্পের তুলনায় অনেক বেশি অনুভূত হয়।
২. জনবহুল নগরীগুলো বেশি ঝুঁকিতে। ঢাকার মতো মেগাসিটিতে লাখো ভবন, ভরাট করা নরম মাটি, অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ— সব মিলে অগভীর ভূমিকম্পে ক্ষতি গুরুতর হতে পারে।
৩. লিকুইফ্যাকশন ও ফাটল বাড়ার আশঙ্কা। নরম পলিতে মাটি তরলসদৃশ হয়ে ভবনের ফাউন্ডেশন দুর্বল হতে পারে।
৪. দুর্বল ভবনে কাঠামোগত ক্ষতি। একই মাত্রার ভূমিকম্প বেশি গভীরতা হলে যেটি হয়তো টের পাওয়া যেত না, অগভীর হওয়ার কারণে তাতে দেয়াল ধস, প্লাস্টার খসে পড়া বা ফাটল দেখা দিতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকি নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর—
১. ম্যাগনিচ্যু ড (মাত্রা)
২. উপকেন্দ্র থেকে দূরত্ব
৩. ভবনের কাঠামোগত মান
গভীরতা তার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান মাত্র।
অতএব ১০ কিলোমিটার গভীরতা মানেই ভয়ঙ্কর নয়। কিন্তু মাত্রা বেশি (৫.৫ বা তার বেশি) হলে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ নগরীতে অগভীর ভূমিকম্পে ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।