পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ যত বাড়ছে, ভয়াবহ কিছু পরিবেশগত বিপর্যয় তত দ্রুত মানবজাতির দিকে ধেয়ে আসছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, এরই মধ্যে ৫টি ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। আমাদের সামনে বিপর্যয়গুলো যেকোনো সময় প্রকট প্রভাব নিয়ে হাজির হতে পারে।
২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা প্রাক্-শিল্পযুগের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে বেঁধে রাখা না গেলে আরও তিনটি বিপর্যয় অতি দ্রুতগতিতে আঘাত হানবে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন।
এসব পরিবর্তন রোখা সম্ভব না হলে আগামী শতকগুলোতে যেসব বিপর্যয় পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে, তা ঠেকানো সম্ভব হবে না। এসব বিপর্যয় মানুষ ও প্রকৃতির এমন ক্ষতি করবে যে তা কোনোভাবেই সংশোধন করা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের গ্লোবাল সিস্টেম ইনস্টিটিউটের টিম লেনটন বলেন, ‘বর্তমান পৃথিবী টিপিং পয়েন্ট বা লক্ষণবিন্দুতে রয়েছে এবং এমন সব লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে, যা মানবজাতি আগে কখনো দেখেনি।’
টিম লেনটন বলছেন, পৃথিবী এখন যে টিপিং পয়েন্ট বা লক্ষণবিন্দুতে রয়েছে, সেগুলো এমন হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, যা মানবেতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে ‘ডমিনো ইফেক্ট’ চালু করে দিতে পারে। এর ফলে পুরো পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়তে পারে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের উৎপাদন মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। এর সামাজিক প্রভাব হিসেবে গণবাস্তুচ্যুতি দেখা দিতে পারে অর্থাৎ দুর্যোগের কারণে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক মানুষকে ঘরবাড়ি ছাড়তে হতে পারে। দেশে দেশে রাজনৈতিক ও আর্থিক বিপর্যয়ও দেখা দিতে পারে।
বিপর্যয়কর হিসেবে চিহ্নিত এই টিপিং পয়েন্টের লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকে বিশাল বরফের গলে পড়া। এ ছাড়া পার্মাফ্রস্টের ব্যাপক গলন, কোরাল রিফের মৃত্যু, সাগরের পানি উষ্ণ হয়ে যাওয়া এবং উত্তর আটলান্টিকে বায়ুপ্রবাহের চক্র ধ্বংস হওয়ার মতো বিষয়ও আছে।
তীব্র তাপপ্রবাহ বা ব্যাপক বৃষ্টিপাতের মতো জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো যেমন গ্রিনহাউস ইফেক্টের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়, উল্লিখিত পরিবর্তনগুলো সেভাবে ঘটে না। এই পরিবর্তনগুলো হঠাৎই ঘটে যায়। তাই এ ধরনের জলবায়ুগত পরিবর্তন আমাদের গ্রহব্যবস্থাকে হুট করেই চিরদিনের জন্য পাল্টে দিতে পারে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বেজোস আর্থ ফান্ডের অর্থায়নে ২ শতাধিক বিজ্ঞানীর একটি দল এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁরা বলছেন, উল্লিখিত সম্ভাব্য বিপর্যয়গুলোর কোনো একটি ঘটে গেলেই পৃথিবী আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে এবং আমাদের আবহাওয়ার প্রবণতা চিরদিনের জন্য বদলে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ‘টিপিং ক্যাসকেড’ বা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত লক্ষণগুলোর সঙ্গে আমাদের বাস্তুতন্ত্র দৃঢ়ভাবে যুক্ত। ফলে বিষয়টি নিয়ে ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
উদাহরণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি কোনো কারণে গ্রিনল্যান্ডের বরফস্তর গলে যায়, তাহলে আটলান্টিক মেরিডিওনাল ওভার টার্নিং সার্কুলেশন নামে আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণ অংশে পানি প্রবাহের যে চক্র রয়েছে, তা বদলে যেতে পারে। এই স্রোত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি আটলান্টিকের আশপাশের উপসাগরগুলোর পানিতে উত্তাপ সরবরাহ করে। ফলে পৃথিবীতে এল নিনোর অবস্থান আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। এমনটা হলে খরা, তীব্র দাবদাহ ইত্যাদি তাপসংক্রান্ত বিপর্যয় বেড়ে যাবে।
জার্মানির পটসডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চের গবেষক সিনা লরিয়ানি বলেন, ‘অনিশ্চয়তা থাকার পরও টিপিং পয়েন্ট ঝুঁকিগুলো আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়কর হয়ে দেখা দিতে পারে এবং বিষয়টি কোনোভাবেই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঝুঁকির সর্বশেষ সীমা পেরিয়ে যাওয়ার ফলে ধরিত্রী ব্যবস্থায় মৌলিক ও আকস্মিক কিছু পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এর ফলে সামনের এক শ বা হাজার বছরের জন্য আমাদের ধরিত্রী ব্যবস্থায় অপরিহার্য অংশগুলোর ভাগ্য অপরিবর্তনীয়ভাবে বদলে যেতে পারে।’
আন্তর্দেশীয় জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেলের (আইপিসিসি) সর্বশেষ জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত টিপিং পয়েন্ট বা লক্ষণবিন্দুর বিষয়টি অস্পষ্ট, কিন্তু পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এই ঝুঁকিগুলো থেকে উদ্ভূত বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।
তবে পর্যালোচনায় কিছু আশার কথাও বলা হয়েছে, যেমন জলবায়ুগত বিপর্যয়ের আশঙ্কা যত ঘনিয়ে আসছে, ততই পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির বিক্রি অনেক বাড়ছে। এই পরিবর্তনগুলো সহজে সম্ভব হতো না। কিন্তু বিপদ সামনে চলে আসায় তা দ্রুততর হয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান