ভূমিকম্প হলে করণীয় সম্পর্কে জানা না থাকায় গত শুক্রবার আহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনিতে কী করবেন বুঝতে না পেরে আতঙ্কে কেউ লাফ দেন, কেউ দৌড় দেন, কেউবা দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন, আবার কেউ ঝাঁকুনিতে নিচে পড়ে গেছেন। তাঁদের কারও মাথায় আঘাত লেগেছে, অনেকের হাত বা পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ রয়েছেন।
ভূমিকম্পে আহত বেশ কয়েকজন এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা থাকলে আহতের সংখ্যা কম হতো।
রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ভূমিকম্পে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় ২০০ জন গত শুক্র ও গতকাল শনিবার চিকিৎসা নেন। তাঁদের মধ্যে এ দুই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২৮ জন। আহত অন্যরা অন্যান্য হাসপাতাল-ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। অনেকে সামান্য আহত হওয়ায় হাসপাতালে যাননি। শুক্রবারের ভূমিকম্পে রাজধানী ঢাকা, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে শিশুসহ ১০ জন নিহত হন।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান সূত্র জানায়, ভূমিকম্পে আহত ব্যক্তিদের ১১৯ জন গত দুদিনে এই হাসপাতালে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে ভর্তি করা হয়েছে ২৩ জনকে। বাকিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বাসায় পাঠানো হয়েছে।
ভূমিকম্পে আহত ব্যক্তিদের কয়েকজন ভর্তি রয়েছেন পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে। গতকাল সেখানে গিয়ে তাঁদের অন্তত আটজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমিকম্পের সময় তাঁরা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। ভূমিকম্প হলে কী করতে হবে, তা জানতেন না। আতঙ্কিত হয়ে বাঁচার চেষ্টা করে আহত হয়েছেন।
সেখানে চিকিৎসাধীন গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষার্থী আবু সাঈদ (২৫) জানান, ভূমিকম্পের সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম হলের দ্বিতীয় তলায় নিজের কক্ষে শুয়েছিলেন। হঠাৎ বিছানা নড়ে ওঠে, পুরো ভবন যেন ঝাঁকি খাচ্ছে। এর মধ্যে জানালার কাচ ভাঙার শব্দে তিনি ভয় পেয়ে যান। মনে হচ্ছিল পুরো ভবন বুঝি ভেঙে পড়বে। হলের অনেকে দৌড়ে বাইরে বের হতে থাকেন। কোনো উপায় না দেখে তিনি দোতলা থেকে লাফ দেন। নিচে ঢালাইয়ের ওপর পড়ায় ডান পা ভেঙে গেছে, অস্ত্রোপচার করতে হবে।
আবু সাঈদের পাশেই চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আব্দুস সোবহান (৫৪)। তিনি শুক্রবার সকালে এলাকার গলির চায়ের দোকানে বসেছিলেন। দেখেন, আশপাশের ভবনগুলো নড়ছে, কাঁপছে। মানুষের চিৎকার ও দৌড়াদৌড়ি শুরু হলে তিনিও দৌড় দিলে পড়ে যান। তাঁর ওপর দিয়ে মানুষ দৌড়াতে থাকে। তাঁর হাঁটুর অংশে একটা হাড়ে ফাটল ধরেছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, দ্রুতই ভালো হয়ে যাবে।
মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারে একটি নির্মাণাধীন ভবনের চারতলা থেকে ভূমিকম্পের সময় রডের ওপর পড়ে গুরুতর আহত হন শাহাদাত হোসেন (৩৫)। পড়ার পর তিনি অচেতন হয়ে যান। তিনি পঙ্গু হাসপাতালের ‘বি’ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তাঁর পরিবার জানায়, শাহাদাতের ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। কোমর ও বুকের হাড়ে ফাটল আছে। অস্ত্রোপচার করার কথা বলেছেন চিকিৎসকেরা।
আহত শাহাদাত খুব ধীরে ধীরে বললেন, কয়েকজন কাজ করছিলেন। তিনি ভবনের এক পাশে ছিলেন। হঠাৎ ভবন নড়ে যাওয়ায় অন্যরা একদিকে চলে গেছেন। তিনি যেতে পারেননি, ঝাঁকুনিতে নিচে পড়ে যান।
জুরাইন রেলগেট এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছয় তলায় কাজ করার সময় ভূমিকম্পের তীব্র ঝাঁকুনিতে রাজমিস্ত্রি ধলা মিয়া পাঁচ তলার ছাদে পড়ে যান, দুই পায়েই আঘাত পান। ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই মুহূর্তে কী করব বুঝতে পারছিলাম না।’
১৪ বছরের শিশু সাকিব খান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায় নিজ বাসায় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় ঝাঁকুনিতে সিঁড়িতেই পড়ে যায়। এতে তার বাম ঊরুর ওপরের হাড় ভেঙে যায়। তার পায়ে অস্ত্রোপচার করতে হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক মো. আবুল কেনান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভূমিকম্পের কারণে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের অবস্থা স্থিতিশীল। কারোর অবস্থাই গুরুতর নয়, মৃত্যুর ঝুঁকি নেই। রোগীদের বেশির ভাগই পায়ে ও মাথায় আঘাত পেয়েছে। বেশির ভাগই ভয়ে নামতে গিয়ে বা লাফ দিয়ে পা ভেঙেছে। সবাইকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল সূত্র জানায়, ভূমিকম্পে আহতদের মধ্যে ৬৬ জন গত দুদিনে এই হাসপাতালে আসেন। তাঁদের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীসহ পাঁচজন ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
বিকেলে ঢামেক হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, মাথা, ঘাড় ও বাম পাঁজরে ব্যান্ডেজ নিয়ে শুয়ে আছেন হারুন অর রশীদ (৫৫)। তিনি মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পাশের ছয় তলার দেয়াল ধসে পড়ে আহত হন।
ভূমিকম্পের সময় গুরুতর আহত মগবাজারের মীরেরবাগের রিকশাচালক আবু বকর সিদ্দিক (৫৫) ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তিনি গতকালও অচেতন ছিলেন। তাঁর ছেলে তৌহিদুল জানান, তাঁর বাবা চা-পান করতে বাইরে বের হয়েছিলেন। এ সময় পাশের নির্মাণাধীন ভবনের ওপর থেকে দেয়াল ধসে তাঁর মাথায় পড়লে গুরুতর আহত হন।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক মোস্তাক আহমেদ বলেন, ভূমিকম্পের সময় ভবন থেকে লাফ দিয়ে ও মাথায় ইট পড়ে আহত পাঁচজন ভর্তি রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আবু বকর সিদ্দিকের মাথায় গুরুতর আঘাত রয়েছে। তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক। বাকিদের সেরে উঠতে সময় লাগবে।