মাহমুদুর রহমান বেনু
১৯৭১ সালে যে সব শিল্পীরা সংগ্রাম ও স্বাধীনতার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন, মাহমুদুর রহমান বেনু তাদের অন্যতম। গ্রামাঞ্চলে গান গেয়ে শরনার্থী শিবিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন তারা। মাহমুদুর রহমান বেনুর ইচ্ছা ছিল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার। প্রশিক্ষণেও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তার ভাইয়ের ছেলে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তাকে উদ্ধার করতে প্রশিক্ষণ ছেড়ে যেতে চাইলে কমান্ডার ছুটি দেননি। বাধ্য হয়ে প্রশিক্ষণ বাদ দিয়ে ফিরে আসতে হয় তাকে। নিয়ম ছিল- যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একবার ফিরে গেলে তাকে আর গ্রহণ করা হয় না। ফলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা করেন বেনু।
ওই সময় কলকাতার লেলিন রোডের ১৪৪ নম্বর বাড়িতে একদল শিল্পী মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। বেনু ছিলেন সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সেক্রেটারি। এ সংগঠনে যুক্ত ছিলেন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার, নজরুল সঙ্গীত শিল্পী শাহীন সামাদ, ছায়ানটের সনজিদা খাতুনসহ ৭৫ জনের মতো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বেনু বলেন, ‘কলকাতার একটি শরণার্থী শিবিরে আমাদের গান গাইবার কথা, কিন্তু এমন এক পরিবেশে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে গান গাওয়া তো দূরের কথা, পানির মধ্যে গরু-ছাগলেরও বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। সেই পরিবেশে আমরা গান গাইব না শুনতে পেয়ে শরণার্থী শিবিরের লোকজন বলছিল, বাবা এই পানির মধ্যেই আমরা তিন দিন ধরে অপেক্ষা করছি আপনাদের জন্য, আপনারা আসবেন , আমরা মুক্তির গান শুনব। ওরা হিন্দুও নয় বৌদ্ধও নয় ওরা বাঙালি।’ একের পর এক তিনি গাইতে থাকলেন ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’-র মতো একাত্তরের সেই কালজয়ী গানগুলো।
১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের প্রামাণ্যচিত্র ধারণের জন্য মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন এসেছিলেন বাংলাদেশে। যুক্ত হয়েছিলেন বেনু ও তার সঙ্গীদের সাথে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য কোনও ব্যবস্থা না থাকায় লেয়ার লেভিন দলটিকে একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করে দেন। সেই ট্রাকে করে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার শিল্পীরা ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবির ছিল। পরবর্তীতে অর্থাভাবে লিয়ার লেভিন তার তোলা ২২ ঘণ্টার ভিডিও চিত্রগুলো দিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে পারেননি।
প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ সম্পর্কে বেনুর চাচাতো ভাই। ১৯৯০ সালে বেনুর মাধ্যমে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লিয়ার লেভিন সম্পর্কে। লেভিনের সেই ভিডিওচিত্রগুলো কিনে নেন তারেক মাসুদ। ওই সময়ে তোলা ভিডিওচিত্রের ওপর ভিত্তি করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তৈরি করেন ‘মুক্তির গান’।
আরতি ধর
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নারী শব্দসৈনিক শিল্পী আরতি ধর। ১৯৪৫ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি প্রগাঢ় ঝোঁক ছিল তার। ভারতে গিয়ে বিভিন্ন সংগীতগুরুর কাছে গান শেখার সুযোগ লাভ করেন আরতি। লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে গানের জগতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন। এরপর ঢাকা থেকে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হলে ১৯৬৬ সাল থেকে টেলিভিশনে গান গাইতেন আরতি ধর। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ কণ্ঠশিল্পী স্বাধীনতার সংগ্রামী চেতনার গান পরিবেশন করে লাকো বাঙালির মনে স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রেরণা জাগিয়ে তোলেন। গণমুক্তি শিল্পীগোষ্ঠরি সাথেও সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতা শুরু হলে আরতি ধরও ছিলেন পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসরদের কড়া নজরে। বেশ কয়েকবার তার বাড়ির সামনেই পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি থেমেছে। তারা আরতি ধরের খোঁজ করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন আরতি। আবার ফিরে যান ভারতে। সেখানে গিয়ে মিলিত হন আগের শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে। তারা একত্রে আবার শিল্পীগোষ্ঠীর কাজ করা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন চার নম্বর সেক্টরে ফরিদ গাজীর নেতৃত্বে। বিভিন্ন এলাকায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন আরতি ধর এবং তার সহকর্মীরা।
স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ের উদ্দীপনামূলক গানগুলো সম্পর্কে আরতি ধর বলেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের গানগুলো গাইতাম আমরা। তখন তো সবার মুখে মুখে ছিল গানগুলো। সীমান্ত এলাকায় গান পরিবেশ করতে গিয়ে একদিন বেশ রাত হয়ে যায়। হঠাৎ দলছুট হয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত সেই রাতে আর শিবিরে ফিরতে পারিনি। একটা বাড়তে আশ্রয় নিয়ে রাত কাটাতে হয় বাবা িএবং আমাকে। এভাবে শত কষ্টে ৯ মাস অতিক্রম করি।’
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আরতি ধর আবার বেতার এবং টেলিভিশনে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে গান গাওয়া শুরু করেন। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ২৮ জন শিল্পী ও শব্দসৈনিককে সম্মাননা জানানো হয়। সেখানে আরতি ধর সম্মাননা পদক গ্রহণ করেন।
ক্যাপশন: [বাঁ থেকে] মাহমুদুর রহমান বেনু ও আরতি ধর