ঘরের ভেতর সাজানো দৃষ্টিনন্দন নানা পুরস্কার। এর কোনোটিতে লেখা ইংরেজি, আবার কোনোটিতে হিন্দি। স্মারকের গায়ে ঝলমল করছে সোনালি অক্ষরে লেখা একটি নাম—নিশিতা নাজনীন নীলা। কৃষিতে সম্পৃক্ত থাকার অংশ হিসেবে নীলার হাতে উঠেছে এসব পুরস্কার।
ছোটবেলা থেকে কৃষির প্রতি প্রেম
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পানিকাউরিয়া গ্রামের মেয়ে নীলা এখন কলারোয়া সরকারি মহিলা কলেজের বাণিজ্য বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিতে স্নাতক শেষ করে বর্তমানে তিনি স্নাতকোত্তর অধ্যয়ন করছেন। মা-বাবা দুজনই কলেজশিক্ষক হলেও নীলার স্বপ্ন ভিন্ন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে স্কাউটসে যোগ দিয়ে শেখেন সেবা, শৃঙ্খলা আর নেতৃত্ব। সেখান থেকে জন্ম নেয় প্রকৃতি ও কৃষির প্রতি ভালোবাসা। মাধ্যমিকে স্কাউটস, পরে কলেজে রোভার স্কাউটসে অংশ নিয়ে জিতেছেন নানা পুরস্কার। ২০২২ সালে খুলনা রেলওয়ে মুক্ত স্কাউটস গ্রুপের হয়ে পাঁচ দিনব্যাপী ১৭০ কিলোমিটার পথ হেঁটে অর্জন করেন ‘পরিভ্রমণ ব্যাজ’।
দেশ-বিদেশে সম্মানিত
এ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের ১০টির বেশি পুরস্কার জিতেছেন নিশিতা নাজনীন নীলা। এগুলোর মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ ইংল্যান্ড, ভারত ও নেপালের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন তিনি। ২০২২ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট তাঁকে উদীয়মান বিজ্ঞানীর সম্মাননা এবং সঙ্গে অর্থমূল্য লক্ষাধিক টাকা পুরস্কৃত করে। ২০২৪ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল হর্টিকালচার সোসাইটি তাঁকে ‘গার্ডেন মেরিট অ্যাওয়ার্ড’ এবং আড়াই লাখ টাকা অর্থমূল্যের পুরস্কার দেয়। সবশেষে, ২০২৫ সালে নেপালের কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ তাঁকে সম্মানিত করে ‘গ্লোবাল অ্যাগ্রো লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে। দেশেও তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি সম্মাননা। এসব তাঁর কৃষির প্রতি অবিচল নিষ্ঠারই স্বীকৃতি।
খামারেই সুখ, কৃষিতেই জীবন
নীলার বাড়িতে প্রবেশ করলে বোঝা যায়, কৃষি তাঁর নিছক আগ্রহ নয়, ভালোবাসা। তাঁর বাড়ির খামারে রয়েছে অর্ধশতাধিক গরু, ছাগল, ভেড়া, খরগোশ। দেশীয় হাঁস-মুরগির সঙ্গে পালিত হচ্ছে বিদেশি প্রজাতির পাখি ও কবুতর।
এক একর জমিতে আমবাগান, এক বিঘা জমিতে বাঁশঝাড় আর মেহগনিগাছের বাগান, জলাশয়ে মিশ্র মাছ চাষ এবং দেড় শ প্রজাতির উদ্ভিদের সমাহার রয়েছে। সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছও রয়েছে তাঁর বাগানে। ‘দিনের পর দিন আমি গাছের সঙ্গে থাকি। তাদের যত্ন নিতে নিতে মনে হয়, এরা আমারই সন্তান,’—হাসিমুখে বললেন নীলা।
মানবতার পরশ
নিশিতা নাজনীন নীলা কৃষি উদ্যোগের বাইরেও আছে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাতক্ষীরা শহরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন পাঁচজন অসহায়, স্বজনহীন বৃদ্ধাকে। নিজেই তাঁদের সেবাযত্ন করেন, চিকিৎসা ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। কোনো সংগঠন নয়, শুধু নিজের ভালোবাসা থেকে নীলা এই কাজ করছেন কয়েক বছর ধরে। নীলা মনে করেন, ‘মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
কৃষিতেই স্বপ্ন বোনেন
নীলার বাবা মো. আবদুল ওহাব এবং মা মোছা. বদরুন্নেছা মেয়ের কৃষিপ্রেমে গর্বিত। নীলা চাকরি নয়, কৃষিকেই জীবনের পথ হিসেবে বেছে নিতে চান। নীলা বলেন, ‘আমার দাদা-চাচারা কৃষিকাজ করতেন। আমি তাঁদের পথ ধরেই হাঁটতে চাই। লেখাপড়া শেষে কোনো চাকরি করব না, বরং কৃষির মাধ্যমে মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিতে চাই।’