নরসিংদীর সদর থানা এলাকায় ২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল মেঘনা নদীতে ভাসমান অজ্ঞাতনামা এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ফেসবুকে ছবি দেখে পুলিশের সহায়তায় পরিবার নিশ্চিত হয় মরদেহটি লিপা আক্তার নিপার। অজ্ঞাতনামা হিসেবে মরদেহ দাফনের পর নরসিংদী সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়।
পরবর্তীতে নিপার মা কোহিনুর বেগমের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে নরসিংদী সদর থানায় হত্যা মামলা হয়। মামলাটি প্রথমে নৌ-পুলিশ তদন্ত করলেও কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পিবিআইয়ের তদন্তে দেড় বছরের বেশি সময় পর বেরিয়ে এল নিপা হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য।
জানা যায়, নিপার সঙ্গে সম্পর্ক মেনে নেয়নি প্রতিবেশী প্রেমিক আমিনুলের পরিবার। পরে আমিনুলের বাবা নিপাকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেন। এক সন্তান নিয়ে সুখের সংসারই ছিল নিপার। কিন্তু সেই সুখ নষ্ট করেন আমিনুল। সংসার ভেঙে যায়। নিপা ফিরে আসেন বাবার বাড়ি। এরপর পুরোনো প্রেমিক আমিনুল ইসলাম ওরফে আমিরুলের সঙ্গে আবার যোগাযোগ শুরু হয় নিপার। একপর্যায়ে নিপা গর্ভবতী হয়ে পড়েন। তখন আমিরুলকে বিয়ের জন্য চাপ দেন নিপা। কিন্তু পরিবারের বাধার কারণে বিয়ে না করে হত্যার পরিকল্পনা করেন আমিরুল।
২০২০ সালের ২৪ এপ্রিল রাতে বিয়ের কথা বলে নিপাকে ঘর থেকে নিয়ে যান আমিরুল। মেঘনা নদীর মাঝে নৌকায় নিপাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ভাসিয়ে দেন। আমিরুলসহ এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন মোট সাতজন। এর মধ্যে আমিরুলের বন্ধু সুজন মিয়া ও চাচাতো ভাই জহিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। প্রধান আসামি আমিরুল পলাতক রয়েছেন। বাকি চারজন বর্তমানে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান পিবিআই নরসিংদী জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. এনায়েত হোসেন মান্নান।
গ্রেপ্তার দুজনের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে তিনি বলেন, আমিরুলের সঙ্গে নিপার দীর্ঘ দিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমিরুলের বাবা তাঁদের সম্পর্ক মেনে নেননি। বরং নিপাকে বিয়ে দিতে ঘটকালি করেন আমিরুলের বাবা। বিয়ের পর নিপা এক বছর সংসার করেন। সেখানে তাঁর একটি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়।
তখন আমিরুলকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন নিপা। এর মধ্যে আমিরুল অন্য সহযোগীদের নিয়ে নিপাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী গত বছরের ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যার পর নিপাকে বিয়ের কথা বলে নৌকায় করে মেঘনা নদীতে নিয়ে যান। মাঝ নদীতে নিয়ে গামছা দিয়ে শ্বাসরোধ করে এবং কাঠ দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে নিপার মৃত্যু নিশ্চিত করেন তাঁরা।
পিবিআই কর্মকর্তা আরও বলেন, নিপাকে হত্যার পর চরের কোথাও মরদেহ মাটিচাপা দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। কিন্তু নদীর সবদিকে জেলেদের উপস্থিতি থাকায় মরদেহটি নদীতে ভাসিয়ে দেন তাঁরা। হত্যায় ব্যবহৃত গামছা ও সঙ্গে থাকা কোদাল নদীতে ফেলে দেন। এমনকি নৌকাটিও অন্যত্র বিক্রি করে দেন তাঁরা। পরে নৌকাটিকে আলামত হিসেবে সংগ্রহ করতে পেরেছে পিবিআই।
পরে ঘটনাস্থল থেকে মেঘনার প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে নিপার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে অজ্ঞাতনামা হিসেবে দাফন করা হয়। পরে ফেসবুকে দেখে পরিবার নিপার মরদেহ শনাক্ত করে। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করতে গিয়ে পরিবার নানা ধরনের ভয়ভীতির সম্মুখীন হয়। পরে আদালতে নিপার মা কোহিনুর বেগমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নরসিংদী সদর থানায় হত্যা মামলা হয়।
এক প্রশ্নের জবাবে পিবিআইয়ের এসপি এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, প্রধান অভিযুক্ত আমিরুল বিদেশে পলাতক বলে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি আমরা এখনো নিশ্চিত নই, আমরা তাঁকে খুঁজছি। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি চারজন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে রয়েছেন।
এসপি এনায়েত যখন নিপা হত্যার ঘটনা বর্ণনা করছিলেন তখন পাশা বসে অঝোরে কাঁদছিলেন মা কোহিনুর বেগম। মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে পদে পদে হেনস্তা ও অসহযোগিতার কথা বলেন তিনি। কোহিনুর বেগম বলেন, আমার মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে থানা-পুলিশ সহযোগিতা করে আসছিল। আসামিরা স্থানীয়ভাবে প্রভাশালী হওয়ায় আমি কারও কাছে সহযোগিতা পাইনি। মেয়ে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে আমি বাড়িছাড়া। প্রবাসে থাকা স্বামী খলিলুর রহমানও তাঁদের ভয়ে মামলা না করার জন্য বলছিলেন। কিন্তু কোনো হুমকি ধমকিতেই আমি থেমে যাইনি। বাড়িছাড়া হয়েও মেয়ে হত্যার বিচারের জন্য নানা জায়গায় চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সর্বশেষ পিবিআইয়ের মাধ্যমে আমার মেয়ে হত্যায় জড়িতরা গ্রেপ্তার হয়েছে।