হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

খালেদা জিয়া আপসহীন নেত্রী

আব্দুল্লাহ নাজিম আল মামুন

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারাল একজন দেশপ্রেমী, অকুতোভয়, নির্ভীক ও আপসহীন নেত্রীকে। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে তিনি ভালোবাসতেন এই দেশকে, এ দেশের মাটি ও মানুষকে। তিনি ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন ২০০৩ সালে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানকেও প্রদানের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার বাতিল করে দেন। তবে চলতি বছর অন্তর্বর্তী সরকার জিয়াউর রহমানের পুরস্কার পুনরায় বহাল রেখেছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রথম স্বাধীনতা পুরস্কার চালু করেন।

প্রতিপক্ষের প্রতি কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে ভূষিত হওয়া পুরস্কার বাতিল করা হয়, তা আমরা শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই দেখতে পেয়েছি। অন্যদিকে খালেদা জিয়া ছিলেন উদারতার মূর্ত প্রতীক। শত্রুকেও বুকে টেনে নিতেন। ন্যায়ের ভাষায় কথা বলতেন। তবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অপ্রতিরোধ্য। তিনি ছিলেন আপসহীন। আপস করেননি কোনো অগণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে। এমনকি গণতন্ত্র রক্ষার্থে তিনি নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। ২০১৪ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়াই যেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে আরও জোরদার করেছিল, যা ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর অন্যতম উপায়। যুগে যুগে দেখা গেছে, কোনো অগণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকতে পারেনি। গণতন্ত্রের উত্তরণে বিএনপির ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ না নেওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর তিনি কিছুটা ভেঙে পড়েন। রাজনীতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল।

সেই অনুরাগ ভাঙাতে এগিয়ে আসেন দলের একাংশের কিছু নেতা-কর্মী। তাঁদের অনুরোধে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন রাজনীতিবিদ। জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপির নেতৃত্বে আসেন খালেদা জিয়া, ১৯৮৩ সালে। তিনি প্রথমে এককভাবে এবং পরে ৭ দলীয় জোট গঠন করে তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রধান এরশাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জন করে বিরোধিতা করেন, যা তৎকালীন বিরোধীদের মধ্যে দৃঢ় নেতৃত্বের পরিচয় বহন করে এবং আপসহীনতার স্পষ্টতা ফুটে ওঠে। এরপর ১৯৮৭-৯০ সাল পর্যন্ত টানা হরতাল, মিছিল, সমাবেশ, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন ঘটে, যার মূল নেতৃত্বে ছিলেন খালেদা জিয়া।

১৯৯০ সালে গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জয়ী হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথরেখায় এটি ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

খালেদা জিয়াই প্রথম গণভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন, যা গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। ১৯৯১ সালের দ্বাদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্সিয়াল থেকে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেন তিনি, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পরিবর্তনের অন্যতম বড় মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং স্বল্পতম সময়ে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে শান্তিপূর্ণভাবে। এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক পরিবর্তন।

এরপর ২০০১ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান। খালেদা জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, যিনি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু নারী বলে নয়; একজন দৃঢ়চেতা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হিসেবে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃত হয়েছে।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন কখনো সহজ ছিল না। তিনি হয়েছেন কারাবন্দী, হয়েছেন গৃহবন্দী। তাঁর ওপর চাপানো হয়েছে মামলার পাহাড়, স্বাস্থ্য নিয়ে করা হয়েছে অবহেলা। তবু তিনি কখনো নিজের নীতিতে আপস করেননি। তাঁর ‘আপসহীন’ তকমাটি শুধু কাগুজে নয়, সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি অভিধা।

২০১৮ সালের পর থেকে বারবার অসুস্থ হলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে যে অমানবিকতা দেখিয়েছে, তা বহুবার আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অথচ দেশের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটি ছিল তাঁর প্রাপ্য মৌলিক অধিকার।

এই দেশের মা, মাটির প্রতি খালেদা জিয়ার ছিল আবেগ ও অসম্ভব ভালোবাসা। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। দেশই হলো আমার ঠিকানা। এই দেশ, এই দেশের মাটি আর মানুষই আমার সবকিছু’—এই আবেগমাখা উচ্চারণ ছিল তাঁর।

তিনি চলে গেলেও আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে তাঁর অদম্য প্রজ্ঞা, সাহসিকতা, মানবিকতা, উদারতা ও আপসহীনতা। এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, ইতিহাসের পাতায়—ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়।

সংগ্রামী জীবনের সমাপ্তি

ফিরে দেখা ২০২৫ সাল

বিদায়ী বছর ভালো কাটেনি, এবার আশা নতুন ভোরের

স্বস্তিটাকে স্থায়ী রূপ দিতে পারবেন তো

পঞ্চাশ বছরের উচ্চশিক্ষা

ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয়

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ