মিসরের জন্য দেশটির এবারের প্রতিনিধি পরিষদ নির্বাচনের তাৎপর্য অনেক। এ ভোটের ফল কেবল পরবর্তী পার্লামেন্টের রূপই নির্ধারণ করবে না, বরং প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির শাসনকাল আবার বাড়বে কি না এবং বাড়লে কত দিনের জন্য তা-ও স্থির করবে।
ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট এবং জনমনে ক্রমবর্ধমান হতাশার প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া প্রেসিডেন্ট সিসির জন্য অনেক কিছু নির্ভর করছে এ ভোটের ওপর।
২০১৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় আসেন আল-সিসি। দ্রুত ক্ষমতা সুসংহত করে দেশে অতি কর্তৃত্ববাদী এক রাজনৈতিককাঠামো গড়ে তোলেন তিনি। ২০১৯ সালে সিসি নিজের ক্ষমতা ও শাসনের মেয়াদ আরও বাড়ানোর জন্য সাংবিধানিক সংশোধনীর ওপর গণভোটের আয়োজন করেন। তাঁর শাসনকাল শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে।
সিসির সরকার গণভোটের ফলাফল নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেয়নি। সংবিধান সংশোধনীর সমালোচনা করা হাজার হাজার ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ‘না’ ভোটের পক্ষে প্রচারণা চালানো লোকজনদের। ভোটারদের ভয় দেখানো, টাকা-পয়সা দিতে হাত করা এবং অপপ্রচার চালানো সবই চলতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে খুব স্বাভাবিকভাবেই সিসি বিপুলসংখ্যক ‘হ্যাঁ’ ভোট পেয়ে জিতে যান। এর মাধ্যমে তাঁর ২০৩০ সাল পর্যন্ত মিসর শাসন করা নিশ্চিত হয়। সেই ২০৩০ সাল আসতে মাত্র চার বছরের কিছু বেশি সময় বাকি। এখন জানা যাচ্ছে, সিসি আরও একবার তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ বাড়াতে চাইছেন।
মনে করা হচ্ছে, সিসি পরবর্তী প্রতিনিধি পরিষদের মাধ্যমে আরেকটি সাংবিধানিক সংশোধনী অনুমোদন করতে চাচ্ছেন। এটি তাঁর ক্ষমতায় থাকার মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত করবে। সম্ভবত অনির্দিষ্টকালের জন্য।
মিসরের পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মধ্যে প্রতিনিধি পরিষদ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সিনেট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিছক পরামর্শমূলক ভূমিকা পালন করে। গত গ্রীষ্মে খুব কম ভোটার উপস্থিতির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে সিনেট নির্বাচন। শাসকগোষ্ঠীর আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়েছিল সেই ভোট। এখন মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকে।
মিসরের ৫৯৬ আসনের প্রতিনিধি পরিষদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এর সদস্যরা সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হন না। প্রতিনিধি পরিষদ এমনভাবে গঠিত যে তা প্রেসিডেন্টের স্বার্থরক্ষা করে চলে। ২৮ জন সদস্য সরাসরি তাঁর দ্বারা মনোনীত হন। বাকি আসনগুলোও এমন সতর্কতার সঙ্গে সদস্য বেছে নেওয়া হয় যাতে স্থিতাবস্থা নিশ্চিত থাকে। এই ৫৬৮টি আসন পৃথক একক আসন এবং তালিকাভিত্তিক—এই দুই ভাগে বিভক্ত। পৃথক আসনগুলোতে ব্যক্তি প্রার্থীরা নিজে নিজে দাঁড়াতে পারেন। তালিকাভুক্ত আসন দলীয় তালিকা অনুযায়ী বণ্টিত হয়। এসব হচ্ছে নিয়মের কথা। বাস্তবে প্রায় সব পৃথক আসন যায় হয় পয়সাওয়ালা প্রভাবশালী ব্যক্তি, নয়তো রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের ঘনিষ্ঠদের হাতে। বাকি তালিকাভিত্তিক আসনে প্রার্থী বেছে নেওয়া হয় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বদলে চূড়ান্তভাবে নিয়ন্ত্রিত এক পদ্ধতিতে। এটা হচ্ছে এক ‘উইনার টেক অল’ পদ্ধতি। এতে ভোটাররা কয়েকটি তালিকার সংগ্রহ থেকে মাত্র একটি দলের তালিকা বেছে নেয়। যে তালিকা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ৫০ শতাংশ ভোট পায় সেখানেই ওই এলাকার ১০০ ভাগ আসন যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, শুধু অনুমোদিত দলীয় তালিকাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
আল-সিসির আমলে মিসরের সব নির্বাচন এবং গণভোটের ফলাফলই কম-বেশি পূর্বনির্ধারিত ছিল। ২০১৪ সাল থেকে শাসকগোষ্ঠী নিয়মিতভাবে সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে আগেই পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বিরোধী প্রার্থীর প্রচারকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে বা ধরপাকড় চালিয়েছে। চলেছে নির্বাচনে আধিপত্য নিশ্চিত করার জন্য ভোটদান প্রক্রিয়ায় কারসাজি বা মিডিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা।
এবারের পার্লামেন্ট নির্বাচনও সেই প্রত্যাশিত নকশামতোই হয়েছে। স্বতন্ত্র আসন এবং তালিকাভিত্তিক আসনব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইতিমধ্যেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। জাতীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ একটি ছাড়া (আল-সিসির ন্যাশনাল লিস্ট ফর মিসর) সব তালিকা বাদ দিয়ে ভোটের লড়াইয়ের ক্ষেত্রকে আরও সংকুচিত করেছে। অভিযোগ উঠেছে, আল-সিসির তালিকায় স্থান পেতে প্রার্থীদের ৩ থেকে ৭ কোটি মিসরীয় পাউন্ড দিতে হয়।
১০ এবং ১১ নভেম্বর প্রথম দফার ভোট গ্রহণের সময় ভোট ‘কেনা’, প্রচারণায় বিধি লঙ্ঘন করাসহ নানা রকম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এর মধ্যে কিছু অভিযোগের বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্যপ্রমাণও মিলেছে। ভোটের জন্য টাকা-পয়সার লোভ দেখানোর বিব্রতকর ভিডিও ছড়িয়েছে অনলাইনে। সিসিকে কিছু এলাকার কয়েকটি পৃথক আসনের নির্বাচন বাতিল করে তারিখ পর্যন্ত পুনর্নির্ধারণ করতে হয়েছিল।
দ্বিতীয় দফার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৫-২৬ নভেম্বর। জাতীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করলেও বিধিবিধানের লঙ্ঘন দৃশ্যত অব্যাহত ছিল। পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফল কয়েক
দিন পরেই ঘোষণা করার কথা। তবে পর্যবেক্ষকরা নিঃসন্দেহ যে সিসির জোটই প্রতিনিধি পরিষদে আধিপত্য পাবে। সিনেট ইতিমধ্যেই তার নিয়ন্ত্রণে।
আল-সিসি আসলে আধুনিক মিসরের জন্য কর্তৃত্ববাদী শাসনের কায়দাকৌশল নতুন করে তৈরি করেছেন। ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, গণগ্রেপ্তার, বিরোধী দল ও গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং কঠোর আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্বৈরাচারী আচরণে তিনি পূর্বসূরিদের ছাড়িয়ে গেছেন। মূলত দমন-পীড়নের এই রেকর্ডের কারণেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরে (নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্র হলেও) আগ্রহী নন। কারণ, ক্ষমতা ত্যাগ করলে তাঁকে জবাবদিহির ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। এই ঝুঁকিটি কাল্পনিক নয়, বরং খুবই বাস্তব। কারণ, ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যে থেকে সিসির প্রতিদ্বন্দ্বীও তৈরি হয়েছে।
পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচনে আল-সিসি বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। প্রায় নিশ্চিতভাবেই তাঁর ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অন্তত আরেকটি ছয় বছরের মেয়াদ পেতে যাচ্ছেন তিনি। আর কিছু না হোক, এটি তাঁর হাতে গা বাঁচানোর জন্য বাড়তি সময় এনে দেবে।
তবে এবারের নির্বাচন সম্ভবত মিসরের এক-ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং ভেঙে পড়া অর্থনীতির ওপর গভীর হতাশা আরও বাড়িয়ে তুলবে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা,
দুর্নীতি এবং দমন-পীড়নের এই মিশেল বিপজ্জনক। ছবিটি মিসরীয়দের খুব পরিচিতও। এটি সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের শাসনামলের শেষ বছরগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। মোবারকও ভেবেছিলেন, তিনি দৃঢ়ভাবে দেশের নিয়ন্ত্রণে আছেন।
প্রকৃতপক্ষে, আরেকটি গণবিদ্রোহ শুরু হওয়া অথবা প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর ‘পল্টি দেওয়া’ হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র। জ্যেষ্ঠ সেনানায়করা ২০১১ সালে যেভাবে হোসনি মোবারককে বলির পাঁঠা করেছিলেন, ঠিক সেভাবেই সিসিকে বিদায় করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
বিষয়টা স্ববিরোধী মনে হতে পারে। তবে নেতারা তাঁদের লৌহমুষ্টির নিষ্পেষণ আরও শক্ত করলেও প্রায়ই উল্টো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
মোহাম্মদ এল-মাসরি, অধ্যাপক দোহা ইনস্টিটিউট অব গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ
(আল-জাজিরা অনলাইনে প্রকাশিত লেখাটি ভাষান্তরিত)