হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

আইনাঙ্গনে এআইয়ের ব্যবহার ও এর সীমাবদ্ধতা

রাইসুল সৌরভ

পৃথিবীজুড়ে মনে করা হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিভিন্ন শিল্পে মানুষের দৈনন্দিন ও পেশাগত কার্যাবলিতে তাৎপর্যময় বিপ্লব ঘটাবে। সুতরাং, আইনাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম থাকবে না। বরং ঐতিহ্যবাহী আইনি পেশায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশে বিশ্বব্যাপী চলা এআই-জ্বরের প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

আইনি কাজে এআইয়ের ব্যবহার আদালতে আইনি জটিল প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ, দলিলাদি ও সাক্ষ্য বিশ্লেষণের পাশাপাশি মামলার ফল ভবিষ্যদ্বাণী বা এ সম্পর্কে পূর্বাভাস বা অভিযুক্তের পূর্বের কার্যাবলি বিশ্লেষণপূর্বক ভবিষ্যৎ অপরাধপ্রবণতা প্রভৃতি জানার জন্যও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই এ কথা বলা যায় যে এই উদীয়মান, শক্তিশালী এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নিঃসন্দেহে কিছু সুবিধা রয়েছে।

তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পূর্বপরিকল্পনা বা যাচাই ছাড়া ঢালাওভাবে এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সতর্কতা না নিয়ে সব কাজে এআই প্রযুক্তি সংযুক্ত করে এর ওপর নির্ভর করার বিপরীত দিকসমূহ অনেক ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক লেখায় বা আলোচনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে এর অভূতপূর্ব সাফল্যের আলোচনার তোড়ে ক্ষতিকর দিকসমূহ, সীমাবদ্ধতা ও অনালোচিত দিকগুলো ভেসে চলে যাচ্ছে। ফলে এই লেখার উদ্দেশ্য হলো আইনাঙ্গনে বা আইন পেশায় এআই প্রযুক্তির কিছু কম আলোচিত বা উপেক্ষিত সীমাবদ্ধতার ওপর আলোকপাত করা; যেন পাঠককুল আইনি কার্যক্রমে এআইয়ের ওপর নির্ভরতার সম্ভাব্য ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হন।

এআই প্রকৃতপক্ষে একটি প্রেডিকশন টুল বা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাস যন্ত্র। এআই প্রযুক্তিকে সক্ষম করার জন্য যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেখানে আসলে প্রচুর পরিমাণ সাবেক বা ঐতিহাসিক তথ্য বা ডেটা ব্যবহার করা হয় এবং সেখান থেকেই এই প্রযুক্তি সম্ভাব্যতামূলক ধরনগুলো শনাক্ত করতে শেখে। ফলে, এটি আসলে মানুষের মতো যুক্তি, চিন্তা বা প্রশ্ন করে না বা এর সে সক্ষমতাও নেই।

আইন, আইনি কার্যক্রম এবং আইন পেশা কেবল কতগুলো নিয়মের সমন্বয় নয় বরং এটি মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের জটিলতা নির্ধারণ করে। কারণ, আইন-আদালতের কাজই হলো মানুষের মধ্যকার সমস্যার সমাধান করা। অতএব, আইন কোনো গণিত বা ফর্মুলা না যে কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে প্রবেশ করিয়ে দিলে অপর প্রান্ত দিয়ে সে সূত্রানুসারে সমাধান হয়ে বের হয়ে আসবে। আইনি জটিলতা তার চেয়ে বেশি কিছু; এটি একটি জীবন্ত ব্যবস্থা এবং সর্বদা পরিবর্তনশীল বিষয়, যা সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং নৈতিক বিবেচনার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়। বিপরীতে এআই প্রযুক্তি মানসিক সহানুভূতি, আবেগ, নৈতিক বিচার, মানবিক অন্তর্দৃষ্টি, কর্তৃত্ব, সামাজিক প্রেক্ষাপট, মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নেওয়ার তাগিদ, দুর্বলের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি নেই; যা সামাজিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে এবং আইনি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাবশ্যকীয়।

অপরদিকে, প্রতিটি মামলা আলাদা এবং সব আইন পেশাজীবী (যেমন: আইনজীবী, বিচারক, ম্যাজিস্ট্রেট, আদালতের কর্মকর্তা ও কর্মচারী) প্রতিটি মামলা একটি অপরটি থেকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করতে পারেন। ফলস্বরূপ, মানব আইনজীবীরা আদালতে তাঁর নিজস্ব মামলায় কেবল আইন প্রয়োগ বা ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন না; বরং প্রয়োজনানুসারে বিচারক এবং আদালতের পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার দক্ষতাও রাখেন। তদানুসারে, সময়-সময় তাঁরা আদালতের প্রতি তাঁদের আচরণ সামঞ্জস্যপূর্ণ করেন; আদালতে বিচারকের মেজাজ, কথার সুর বা ভঙ্গি, সময়, প্রেক্ষাপট এবং চাহিদার সঙ্গে সংবেদনশীলভাবে সাড়া দেন। আর এখানেই এআই মানুষের মতো আদালতে এ রকম অনন্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ।

অধিকন্তু, প্রতিটি মামলা কেন সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য ও তথ্যের ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা হয়, তার একটি যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। কারণ, আদালতে কেবল নামকাওয়াস্তে বিচার সম্পন্ন করলেই চলে না; বরং এমনভাবে বিচার করতে হয় যেন জনসাধারণের কাছে প্রতীয়মান হয় যে ন্যায়বিচার নিষ্পন্ন করা হয়েছে। সুতরাং, জনগণের অধিকার ও আইনি সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য গাণিতিক সূত্র বা অ্যালগরিদমিক প্রযুক্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হলে জনসাধারণ এবং আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি এবং দূরত্ব তৈরি হতে পারে।

তথাপি বর্তমান এআইয়ের যুগে, এই নব্য প্রযুক্তির সহায়তায় আদালতে নিজের মামলা আইনজীবী নিয়োগ না করে নিজেই উপস্থাপনের প্রবণতা দুনিয়াজুড়ে এখন ক্রমবর্ধমান। এ প্রক্রিয়াকে স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলা নামে অভিহিত করা হয় এবং যেহেতু আইনজীবী নিয়োগের জন্য কোনো খরচের প্রয়োজন পড়ে না, তাই দ্রুত স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলা দেশে দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কারণ, এআই চ্যাটবট কাউকে আইনি পরামর্শ বা সহায়তার জন্য কোনো অর্থ নেয় না।

তা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে এআইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বিচারপ্রার্থীর জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, বিচারিক কার্যক্রম সব সময় পরিকল্পনামাফিক আগায় না। বিচার বা শুনানি চলাকালে বিচারক যদি কোনো আইনি জটিল প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জিজ্ঞাসা করেন বা কোনো বিষয়ে স্পষ্টীকরণ চান বা বিচার থেকে সাক্ষ্য অনুপযুক্ত বিবেচনায় প্রত্যাহার করেন, তখন আদালতে এআই চ্যাটবট তাৎক্ষণিক মানব আইনজীবীর মতো বিচারপ্রার্থীর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনে অক্ষম।

উপরন্তু, একটি অনুপযুক্ত জেরার প্রশ্ন বা প্রক্রিয়া বা আদালতে বিচারপ্রার্থীর সঙ্গে অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে কি না, তা যাচাই এবং সেটি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকের কাছে আপত্তি তুলতে সক্ষম নয়। এসব ছাড়াও, আদালত হলো একটি খেলার মাঠের মতো; যেখানে প্রতিপক্ষ হঠাৎ করে নতুন কৌশল নিয়ে আসতে পারে বা কৌশল পরিবর্তন করতে পারে। অতএব, এসব ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীর নিয়োগ করা মানব আইনজীবী তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম; যেখানে স্বপ্রতিনিধিত্বমূলক মামলায় এআই টুল এ ধরনের জটিল সেবা দিতে পারে না।

পাশাপাশি অদ্যাবধি এআই প্রযুক্তি কোনো ভুলের দায়িত্ব গ্রহণ করেনি; না এর প্রোগ্রামার, না এটি নিয়ে যে কোম্পানি ব্যবসা করছে, তারা সে দায়িত্ব নিয়েছে। আদালত যখন এআইয়ের ভুলের জন্য আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থীকে শাস্তি দেবে, তখন কোনো এআই চ্যাটবট এসে তাদের পাশে দাঁড়াবে না। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের উচ্চ ট্রাইব্যুনাল (ইমিগ্রেশন এবং রাজনৈতিক আশ্রয় চেম্বার) আইনজীবীদের বিচারিক কার্যক্রমে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। উক্ত আদালতে সাব্যস্ত হয়েছে যে একজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যারিস্টার এআই চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি দ্বারা তৈরি একটি কাল্পনিক আপিল আদালতের রায় উদ্ধৃত করে ট্রাইব্যুনালকে বিভ্রান্ত করেছেন। তাই উক্ত আইনজীবীর এহেন দায়িত্বহীন আচরণ তদন্তের জন্য যুক্তরাজ্যের বার স্ট্যান্ডার্ডস বোর্ডে রেফার করা হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে আরও বেশ কয়েকজন আইনজীবী আদালত এবং আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক এ রকম দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে এআই আউটপুট যাচাই না করে আদালতে উপস্থাপন করায় তীব্র ভর্ৎসনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। কারণ, চ্যাটজিপিটি থেকে উদ্ভূত কাল্পনিক কেস রেফারেন্স ও পূর্ব নজির হিসেবে মামলায় দাখিল করা হয়েছে। সুতরাং, আইনাঙ্গনে আইনজীবী, বিচারক বা বিচারপ্রার্থী যে-ই মামলায় এআই প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করুক না কেন; দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে। তাই এই প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা যথাযথভাবে না জেনে এবং এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ না নিয়ে বিচারিক কার্যক্রমে এর ব্যবহার সমীচীন নয়।

বিচার বিভাগের ভূমিকা কেবল মামলাসমূহ দক্ষতার সঙ্গে বিচার নিষ্পন্ন করা নয়; বরং এর নৈতিক পরিণতি মূল্যায়ন করা, বিচারে ন্যায্যতা দৃশ্যমান করা এবং সর্বোপরি আইনের শাসনকে এমনভাবে সমুন্নত রাখা, যেন কোনো যন্ত্র বা প্রযুক্তি সেখানে বিভ্রান্তি বা বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। সুতরাং, আদালতে বিচার নিষ্পন্ন করার কাজে আমরা কতটুকু আধুনিক যন্ত্র ও আমাদের নিজস্ব বিবেকের সংমিশ্রণ ঘটাব, সে সম্পর্কে একটি স্পষ্ট রেখা আমাদের অবশ্যই টানতে হবে।

লেখক: ডক্টরাল গবেষক, গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, আয়ারল্যান্ড

সিঁদুরে মেঘের ভয় নয় অমূলক

ওসমান হাদির পরিচিতি অনেকাংশে ম্লান করেছে সহিংসতা

রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট: রাশিয়া ও বাংলাদেশের কৌশলগত অংশীদারত্ব

শঙ্কা যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না

হাদি হত্যা এবং আগামী নির্বাচন

দেশের অর্থনীতির দ্বৈত বাস্তবতা

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ