আসামিদের না ধরে কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার পর্যটককে পুলিশ চরিত্রহীন প্রমাণে ব্যস্ত-টুরিস্ট পুলিশের বিরুদ্ধে এই অভিযোগটি আছে শুরু থেকেই। স্বামী-সন্তানসহ ওই নারীকে নিরাপত্তার দেওয়ার নামে চার দিন ধরে নিজেদের হেফাজতে রাখায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, ওই নারী নিজের পেশার বিষয়ে আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে দাবি করছে পুলিশ, সেগুলো বলতে পুলিশ নিজেই চাপ সৃষ্টি করেনি তো।
যদিও নতুন করে জবানবন্দি দিতে ভুক্তভোগী নারী আবেদন করেননি। তবে মামলার বাদী ওই নারীর স্বামী পুলিশের কাছ থেকে ‘মুক্তি’ মিললে বলতে চান আরও অনেক কথা।
আজ রোববার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে ভুক্তভোগী নারীর স্বামী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা এখানে কিছু বলব না। এই জায়গা থেকে (পুলিশ হেফাজত) বেরিয়ে গেলে অনেক কথা আছে। এখন আমাদের যে পরিবেশে যেটা বলা লাগতেছে সেটিই বলতে হচ্ছে। আমরা চার-পাঁচ দিন ধরে বন্দী। এখানে অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে। তবে এখন আমি কোনো অভিযোগ করব না। কক্সবাজার থেকে আমরা যখন চলে যাব, যখন ঢাকায় যাব বা গ্রামের বাড়িতে ফিরব তখন সবকিছু জানাব। আর আমাদের মধ্যে যদি কোনো দুর্বলতা থাকত, তাহলে আমরা ঘটনার দিন উদ্ধারের জন্য আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে ফোন করতাম না।’
তবে গতকাল টুরিস্ট পুলিশ চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ মুসলিম ভুক্তভোগী নারীকে স্বামী-সন্তানসহ আটকে রেখে চাপ সৃষ্টির বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি করেছেন। দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার এজাহারের বাইরে থাকা তিন যুবককে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানাতে টুরিস্ট পুলিশের কার্যালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে ভুক্তভোগীকে স্বামী-সন্তানসহ আটকে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁদের আটকিয়ে রাখিনি। ভুক্তভোগী হয়তো আমাদের তদন্তে সহায়তা করছেন। এখানে আটকে রাখার বিষয় নেই।’
যদিও ভুক্তভোগী নারীর স্বামী মামলার বাদী বারবারই বলে যাচ্ছেন তাঁদের জোর করেই আটকে রেখেছে পুলিশ। তাঁদের বর্তমানে কক্সবাজার শহরের হলিডে মোড়ের টুরিস্ট পুলিশের রেস্ট হাউসের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। কক্ষের বাইরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে সনাক-টিআইবির চট্টগ্রাম নগরের সভাপতি বিশিষ্ট আইনজীবী আখতার কবির চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী যদি নিজেকে বাইরে নিরাপদ মনে করেন, তাহলে আদালতের আদেশ ছাড়া এভাবে তাঁকে নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারে না পুলিশ। যদি রাখে তাহলে আইনের গুরুতর ব্যত্যয় হবে। পুলিশ যদি ভুক্তভোগীকে নিরাপত্তা দিতেই চায়, সে ক্ষেত্রে তাঁকে অনুসরণ করতে পারে, তিনি যেখানে থাকবেন সেখানে নিরাপত্তা জোরদার করতে পারেন। কিন্তু এভাবে তো নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারেন না।’
আখতার কবির চৌধুরী আরও বলেন, ‘পুলিশ যদি নিজ উদ্যোগে ভুক্তভোগীকে নিজেদের হেফাজতে রেখে অতি উৎসাহ দেখান, নাগরিকদের পক্ষে আঙুল উঠতে পারে পুলিশ অপরাধীর দ্বারা বশীভূত হয়ে অসত্য বক্তব্য দিতে ভুক্তভোগীকে চাপ সৃষ্টি করছে। এই প্রশ্নও উঠতে পারে-পুলিশ অপরাধীদের স্বার্থেই ভুক্তভোগীদের নিজেদের হেফাজতে রেখেছে।’
এদিকে মামলার প্রধান আসামি আশিকুল ইসলামকে আজ রোববার মাদারীপুর থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।এর আগে ধর্ষণের ঘটনায় আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ তবে তাঁরা কেউ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি নন। এজাহারভুক্ত আরও দুই আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন শহরের দক্ষিণ বাহারছড়ার রেজাউল করিম সাহাবুদ্দিন, চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের উলুবুনিয়ার মামুনুর রশিদ ও পশ্চিম বাহারছড়া এলাকার মেহেদী হাসান। আজ রোববার দুপুরে তাঁদের সাংবাদিকদের সামনে আনে পুলিশ। পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিতেই এই ব্যক্তিরা নিজেদের নিরপরাধ দাবি করেন।
তবে পুলিশ চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ মুসলিম দাবি করেছেন, মামলার এজাহারে না থাকলেও ভুক্তভোগীর জবানবন্দিতে এই তিনজনের নাম ছিল। সে জন্য তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
প্রধান আসামিদের এখনো কেন গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নে মোহাম্মদ মুসলিম বলেন, ‘তাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চলছে।’ গতকাল বিকেলে প্রধান আসামি আশিকুল ইসলাম, মো. বাবু ওরফে মেহেদী হাসান বাবু ও ইসরাফিল হুদার বাহারছড়া এলাকার বাসায় যান এই প্রতিবেদক। তবে আশিকুল ও ইসরাফিলের বাসায় কাউকে পাওয়া যায়নি, তাঁদের ঘর তালাবদ্ধ ছিল। আশপাশের মানুষেরা জানান, কয়েকবার পুলিশ আসামিদের বাসায় যাওয়ায়, স্বজনেরা বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।
অন্যদিকে মো. বাবুর বাসায় গিয়ে তাঁর দাদি-চাচিদের পাওয়া যায়। রওশন আরা বেগম নিজের নাতি বাবুকে নিরপরাধ জানিয়ে আজকের পত্রিকার কাছে দাবি করেন, ‘বাবুকে না পেয়ে তাঁর বাবা এবং চাচাতো ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।’ তবে সন্ধ্যার দিকে বাবুর চাচাতো ভাই সাকিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও পুলিশ তাঁদের আটকের বিষয়টি স্বীকার করেনি।