চট্টগ্রামসহ সারা দেশে দুই দফায় সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। এই দুই দফায় চট্টগ্রামের ১৬ আসনের ১৪টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। দুটি আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা বাকি। এই ১৪ আসনের মধ্যে অন্তত সাতটিতে নিজ দলেই বিরোধিতার মুখে পড়েছেন দলের প্রার্থীরা। এসব আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক ও রেল অবরোধ, মশাল মিছিল, সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়নবঞ্চিত কেউ কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কয়েকজন এরই মধ্যে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। বঞ্চিত ব্যক্তিদের আশা, শেষ মুহূর্তে হলেও হয়তো তাঁদের ভাগ্য খুলবে। দলের মধ্যে এমন ‘বিদ্রোহ’ নিয়ে অনেকটা বিব্রত অবস্থায় পড়েছে বিএনপি।
বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করা এই সাত আসন হলো চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড), চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান), চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী), চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি), চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) ও চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী)। এর বাইরে আরও দু-একটি আসনে চাপা ক্ষোভ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে।
দলীয় সূত্র বলেছে, সম্ভাব্য প্রার্থীকে উপেক্ষা করে এরই মধ্যে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন চট্টগ্রাম-৪ আসনের বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা লায়ন আসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৯ আসনের বিএনপির নেতা শামসুল আলম ও আবুল হাসেম বক্কর, চট্টগ্রাম-৫ আসনের এস এম ফজলুল হক ও ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা এবং চট্টগ্রাম-১৬ আসনের বিএনপির নেতা লেয়াকত আলী। তাঁরা গত রোববার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।
দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা সবার বক্তব্য প্রায় অভিন্ন। তাঁরা জানান, দলের দুর্দিনে তাঁরা কাজ করেছেন। মাঠে-ময়দানে থেকে যাবতীয় অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করেছেন। দল শেষ মুহূর্তে হলেও তাঁদের কাজের মূল্যায়ন করবে। দুই দফায় ইতিমধ্যে যে মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়েছে, সেটা প্রাথমিক মনোনয়ন। এতে আরও পরিবর্ধন ও পরিমার্জন সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।
তথ্যমতে, প্রথম দফায় গত ৩ নভেম্বর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন। এ তালিকায় চট্টগ্রামের ১৬ আসনের মধ্যে ছিল ১০টি। সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে নুরুল আমিন, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে সরওয়ার আলমগীর, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে কাজী সালাউদ্দিন, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও) আসনে এরশাদ উল্লাহ, চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী-পাহাড়তলী) আসনে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে মোহাম্মদ এনামুল হক, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে সরওয়ার জামাল নিজাম এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী।
৪ ডিসেম্বর বিএনপির পক্ষ থেকে আরও ৩৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামের চারটি আসন রয়েছে। এই প্রার্থীরা হলেন চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া) আসনে আবু সুফিয়ান, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মোস্তফা কামাল পাশা এবং চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে নাজমুল মোস্তফা আমিন।
এখনো প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) ও চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে। এর মধ্যে বন্দর-পতেঙ্গা আসনে বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে ইস্রাফিল খসরু ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের ছেলে সাঈদ আল নোমানের মনোনয়ন নিয়ে জোর আলোচনা আছে। চন্দনাইশ আসনে বিএনপির জোট শরিক এলডিপির কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রমের নির্বাচন করার কথা রয়েছে।
ঘোষিত ১৪ আসনের মধ্যে অন্তত পাঁচটি প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে বিস্ফোরণোন্মুখ। এগুলো হলো চট্টগ্রাম-৪, চট্টগ্রাম-২, চট্টগ্রাম-৬, চট্টগ্রাম-১২ ও চট্টগ্রাম-১৬। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-৫ ও চট্টগ্রাম-৯ আসনে বিএনপির মনোনয়নের বাইরে কয়েক নেতা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
সব মিলিয়ে নির্বাচনে মনোনয়ন ঘিরে চট্টগ্রামে বিএনপির নিজেদের মধ্যে কোন্দল চলছে চরম আকারে। সীতাকুণ্ডে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আসলাম চৌধুরীর মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশা বেশি থাকলেও যুবদল নেতা কাজী সালাউদ্দিনকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এরপরই তাঁর মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবিতে আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা রেললাইনও অবরোধ করেন। শেষ মুহূর্তে হলেও আসলাম চৌধুরীর মনোনয়ন দরজা খুলবে, এমন প্রত্যাশা সমর্থকদের।
এ বিষয়ে আসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি করার কারণে কী পরিমাণ সামাজিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, তা দলের অজানা নয়। দল আমাকে মূল্যায়ন করবে বলে প্রত্যাশা করি।’
অন্যদিকে কাজী সালাহউদ্দিন মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে মাঠ গোছানোর চেষ্টায় রয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অনুসারীরা যতই বিক্ষোভ করুন না কেন, তিনি মনে করেন না তাঁর মনোনয়নে কোনো আঁচ পড়বে।
এদিকে ফটিকছড়িতে নিজেদের নেতা মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারের অনুসারীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এ আসনে উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার আলমগীরের মনোনয়ন প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন তাঁরা।
রাউজানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে বিএনপির দুই হেভিওয়েট নেতা গোলাম আকবর খোন্দকার চৌধুরী ও গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সমর্থকদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ মাসে রাউজানে খুন হয়েছেন অন্তত ১৭ জন। এর মধ্যে ১২ জনই খুন হয়েছেন বিএনপির দুই গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্বে। সংঘাতের কারণে গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় সহসভাপতির পদ হারান সম্প্রতি। গোলাম আকবরের নেতৃত্বাধীন উত্তর জেলার আহ্বায়ক কমিটিও বিলুপ্ত করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এই আসনে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। এতে ক্ষুব্ধ গোলাম আকবরের অনুসারীরা।
বিদ্রোহের এই দাবানলের মাঝে মনোনয়ন পরিবর্তন হবে, এমন প্রত্যাশা উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক ছাত্রনেতা জসিম সিকদারের। তিনি বলেন, এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শেষ মুহূর্তে দল মনোনয়ন নিশ্চিত করবে।
এদিকে পটিয়ায় দক্ষিণ জেলার সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনামের মনোনয়ন মেনে নিতে পারেননি সাবেক সংসদ সদস্য গাজী শাহজাহান জুয়েল ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়ার অনুসারীরা। মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে গত ১৮ নভেম্বর গুলশান কার্যালয়ে একটি আবেদন জমা দেন তাঁরা। ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক দুইবারের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়া, যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল করিম নেছারসহ অন্য নেতারা।
বাঁশখালীতে সাবেক মন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী পাপ্পা মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে বিস্ফোরণোন্মুখ এই উপজেলা। এই অবস্থায় পুরো বাঁশখালী চষে গণসংযোগ, মিছিল ও সমাবেশ করে ভোটার টানার চেষ্টা করছেন গন্ডামারা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক লেয়াকত আলী। গত ২২ নভেম্বর বাঁশখালীর প্রাণকেন্দ্র জলদীতে বড় সমাবেশ করে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
লেয়াকত আলী বলেন, ‘৪১ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করছি। সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে ছিলাম। নেতাদের ড্রয়িংরুমে হাজিরা দিতাম না বলে ড্রয়িংরুম পলিটিকসে বারবার পরাজিত হয়েছি। মনোনয়ন রাজনীতিতেও পরাজিত হলাম। আগামী জাতীয় নির্বাচনে আমি অংশগ্রহণ করব। এটা আমার সিদ্ধান্ত নয়, বাঁশখালীবাসীর সিদ্ধান্ত। স্বতন্ত্র বা দলীয় বুঝি না, আমি নির্বাচন করব, এটাই শেষ কথা।’