দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের নতুন রেকর্ড হয়েছে। চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতে সীমাহীন লুটপাট হয়। নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে তা আর ফেরত দেয়নি প্রভাবশালী একটি চক্র। শুধু তা-ই নয়, এ চক্রটি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করেও প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়মিত দেখিয়েছে বছরের পর বছর। এতে বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ গোপন থেকে যায়। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র প্রকাশ হতে শুরু করে। এতে হু হু করে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। সেই ধারাবাহিকতায় গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে বিতরণ করা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশই খেলাপি হয়ে পড়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা।
খেলাপি বৃদ্ধির চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে বিআইবিএমের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এটি ৪০ শতাংশের ঘরেও পৌঁছাতে পারে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য স্পষ্ট খারাপ বার্তা বহন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসরণ করে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা কঠোর করায় আগের থেকে অধিক হারে খেলাপি দৃশ্যমান হচ্ছে। এ খেলাপি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্টদের একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ইচ্ছাকৃত খেলাপির বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে অনিচ্ছাকৃত খেলাপিদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকিং সমাধান, নীতিগত ছাড় এবং প্রয়োজনে নতুন করে ঋণসুবিধা দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৭৮ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৫ কোটি, যা বিতরণ করা ঋণের ৩৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ হাজার ১৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকিং খাতের বিপুল ক্ষতির জন্য দায়ী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাঁরা ব্যাংকিং খাতের এ দুরবস্থার জন্য দায়ী, তাঁদের তদন্ত সাপেক্ষে শাস্তির আওতায় আনতেই হবে। কঠোর জবাবদিহি ছাড়া ব্যাংকিং খাতকে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। কেননা, প্রকৃত সমস্যা শনাক্ত করে নির্দিষ্ট সমাধান না হলে ব্যাংকিং খাত আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে। সে জন্য ব্যাংকিং খাতকে বাঁচাতে এখনই সাহসী সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বিগত সরকারের শুরুর দিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রীতিনীতির আলোকে ব্যাংকিং খাত পরিচালিত হচ্ছিল। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগ থেকে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃ তফসিল চালু হয়। এর পর থেকে নানা শিথিলতায় খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। এ ক্ষেত্রে কখনো বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনঃ তফসিল, কখনো ঋণ ফেরত না দিলেও নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেওয়া হয়। গুটিকয়েক ব্যবসায়ীকে সুবিধা দিতে গিয়ে পুরো ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে।
ডলার-সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের দ্বারস্থ হয় বাংলাদেশ। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের তিনটি কিস্তি পেয়েছে। তখন ঋণের শর্ত হিসাবে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু বর্তমান শর্তের বিপরীতে হু হু করে খেলাপি বেড়ে ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি প্রায় ৫০ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোরও খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের কাছাকাছি।