জরুরি সংবাদ সম্মেলন
বিদেশিদের পরামর্শেই সরকার শ্রম আইনের কিছু কিছু ধারায় পরিবর্তন আনছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলেছেন, সরকার দেশীয় ব্যবসায়ীদের চেয়ে বিদেশিদের কথা শুনতেই বেশি পছন্দ করছে। আজ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএর কার্যালয়ে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা শ্রম আইনের তিনটি ধারায় আপত্তি তুলে ধরে সংশোধিত শ্রম আইন-২০২৫ পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান। আপত্তির বিষয় তিনটি হচ্ছে শ্রমিকের সংজ্ঞা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকের সর্বনিম্ন সংখ্যা ও শ্রমিকদের দ্বৈত প্রভিডেন্ট ফান্ড। এ ছাড়া বর্তমান প্রেক্ষাপটে এলডিসি উত্তরণ রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য হুমকি বলে উল্লেখ করে প্রস্তুতির জন্য তিন বছর পেছানোর জোর দাবি জানানো হয়। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর মুনাফায় থাকার পরও বাড়তি মাশুল নির্ধারণ করা অযৌক্তিক উল্লেখ করে এটি প্রত্যাহারের দাবি জানান তাঁরা।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের সভাপতিত্বে ওই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ), বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. শাহরিয়ার, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি তাসকীন আহমেদ, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বাপি) সিইও মেজর জেনারেল (অব.) মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিজিএমইএর নির্বাহী কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
শ্রম আইন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন যে বিষয়গুলোতে আপত্তি তোলা হচ্ছে, তা কেন আগে থেকে সরকারের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে সমাধান করা হয়নি—এমন এক প্রশ্নের উত্তরে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘বিদেশিদের পরামর্শে শ্রম আইন সংশোধন করছে সরকার। আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে সমস্যাগুলো জানাতে চেয়েছিলাম। আমরা চার মাস ধরে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চেয়েও পাইনি। অথচ স্টারলিংকের কোম্পানি স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট এলে তাঁর সঙ্গে উনি দেখা করেন। যে কোম্পানি ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায়। অথচ তিনি ৪০ বিলিয়ন ডলারের খাতের প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করেন না।’
মাহমুদ হাসান খান বাবু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘কারও সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে হলে তার সঙ্গে বসতে হয়। তিনি যদি সময় না দেন তাহলে কীভাবে নেগোসিয়েশন করব? আমরা বারবার সময় চেয়েও পাইনি।’
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে ৩০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি থাকার বিধান রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন মোট শ্রমিকের অনুপাতের শর্তের বদলে ন্যূনতম শ্রমিকসংখ্যা বিবেচনার জন্য সুপারিশ করেছে। সে ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ন্যূনতম ৫০ এবং জাতীয়ভিত্তিক ইউনিয়নের জন্য ন্যূনতম ৪০০ জন শ্রমিকের সম্মতির সুপারিশ করে কমিশন।
তবে গত বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আইনের যে খসড়া অনুমোদন পেয়েছে, তাতে ন্যূনতম শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে ২০ জন করা হয়েছে দাবি করে মাহমুদ হাসান খান বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সভায় একতরফাভাবে সেটি পরিবর্তন করে ২০-৩০০ শ্রমিক নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ধাপ করা হয়েছে ৫টি।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবতাবিবর্জিত বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। কারণ মাত্র ২০ জন শ্রমিক দিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হলে কারখানাগুলোতে এমন ব্যক্তিরা ট্রেড ইউনিয়ন করবেন, যাঁরা ওই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।
তাঁরা বলেন, এটি অন্তর্দ্বন্দ্ব ও শিল্পে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে ও উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমবে এবং উদ্যোক্তারা নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হবেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ভারতে ১০ শতাংশ বা ন্যূনতম ১০০ জন শ্রমিকের সম্মতিতে ইউনিয়ন করা যায়। পাকিস্তানে ট্রেড ইউনিয়ন করতে সম্মতি লাগে ২০ শতাংশ শ্রমিকের।
ভবিষ্যৎ তহবিল ও সর্বজনীন পেনশন প্রগতি—দ্বৈত জটিলতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, টিসিসির আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল একটি প্রতিষ্ঠান চাইলে ‘ভবিষ্যৎ তহবিল’ বা ‘প্রগতি’ যেকোনো একটি স্কিম বেছে নিতে পারবে। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদন দিয়েছে, শ্রমিক চাইলে দুটি পদ্ধতিতেই অংশ নিতে পারবে, যা উদ্যোক্তাকে দুটি ভিন্ন আর্থিক ব্যবস্থাপনা সমান্তরালে চালাতে বাধ্য করবে। এতে প্রশাসনিক জটিলতা, ব্যয় বৃদ্ধি ও তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
শ্রমিকের সংজ্ঞা আগের মতোই রাখার দাবি জানিয়ে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘সংশোধিত শ্রম আইনের সংস্কার কমিশনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল একরকম। কিন্তু খসড়া প্রকাশ হওয়ার পর দেখলাম তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন। কার স্বার্থে এগুলো করা হয়েছে। আমরা শ্রমিক আইন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলাম না কখনই।’
চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে দেওয়াকে ভূরাজনৈতিক কোনো প্রভাব দেখছেন না বলেও জানান মোহাম্মদ হাতেম। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত অনেক ভালো। দেশে যারা আগে পরিচালনা করেছে, তারা কিছু শিখবে হয়তো এখান থেকে।
বন্দরের মাশুল প্রত্যাহারের দাবি
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ব্যবস্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের আওতায় দিতে সরকার চুক্তি করতে যাচ্ছে । আগামী ডিসেম্বরে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে চট্টগ্রামসহ তিনটি বন্দরের কনটেইনার ব্যবস্থাপনা চলে যাচ্ছে। এজন্যই সরকার ১৯৮০ সাল থেকে চলে আসা মাশুল ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল ফি ৪১ শতাংশ বাড়ানো অযৌক্তিক দাবি করে তাঁরা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সেবা ফি নেওয়া হয় ডলারে। ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ২৯ দশমিক ৮৯ টাকা। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গত ৪০ বছরে টাকার অঙ্কে মাশুল ইতিমধ্যেই ৩০৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই বন্দরের মাশুল না বাড়িয়ে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁরা।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন আরও তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের সুদের হার অনেক বেশি, ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পণ্য নিয়ে যেতে এখনো ৭-৮ ঘণ্টা লাগে, জ্বালানির ঘাটতিতে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এসব সমস্যা রেখে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন করলে আমরা চরম প্রতিযোগিতায় পড়ব। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে টিকফা, এফটিএর মতো কয়েকটি চুক্তি করতে হবে। এ জন্য তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবি করছি। তিন বছর পিছিয়ে দিলে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিতে আরও সাত বছর সময় পাবে। তবে এসব সমস্যার সমাধান হলে আগামী বছরই এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনে কোনো আপত্তি নেই আমাদের।’