বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ বলছে, কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করায় বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। দেশে কৃষিপণ্যটির সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। তবে প্রতিবেশী ভারতে পেঁয়াজের দাম কম থাকায় সীমান্তের স্থলবন্দরগুলোর ওপারে কাছাকাছি প্রচুর ভারতীয় পেঁয়াজ জমা করা হয়েছে। এই পেঁয়াজ আমদানি করে মোটা মুনাফা বাগাতে একটি পক্ষ কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে ট্যারিফ কমিশন কৃত্রিম সংকটের বিষয়টি স্বীকার করলেও মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমানোর যুক্তি দিয়ে ‘স্বল্প পরিসরে’ আমদানির সুপারিশ করেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে বর্তমানে আগের মৌসুমের সাড়ে ৩ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত রয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে চলতি মাসেই নতুন মৌসুমের পেঁয়াজ বাজারে আসার বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, চলতি মাসে ১ লাখ টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসবে। আগামী মাসে আসবে এ জাতেরই আরও ২ লাখ ৫ হাজার টন। এমন পরিস্থিতিতে আমদানির পথ খুলে দেওয়া হলে নতুন পেঁয়াজ নিয়ে কৃষক লোকসানে পড়বেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কমে কেজিপ্রতি ৮ রুপিতে (প্রায় ১২ টাকা) নেমেছে। এখন আমদানির অনুমোদন দিলে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের লাভ হবে। ক্ষতি হবে আমাদের কৃষকের। ভারতের ব্যবসায়ীদের লাভের জন্য দেশের কৃষকের ক্ষতি করতে পারি না। এ কারণে বাণিজ্য, কৃষি মন্ত্রণালয়সহ যৌথ কমিটির গত সপ্তাহের বৈঠকে আপাতত পেঁয়াজ আমদানি না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এরই মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কয়েকটি টিম ফরিদপুর, পাবনাসহ পেঁয়াজের উৎপাদন অঞ্চলগুলোতে অভিযান শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার থেকে এই অভিযান শুরুর পর পাইকারি পর্যায়ে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মণপ্রতি দাম ২৫০ টাকার বেশি কমেছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের পেঁয়াজের মজুত পর্যাপ্ত। তারপরও দাম বেড়েছে কারসাজিতে। মনিটরিং টিমগুলো পেঁয়াজের উৎস বাজারগুলোতে কাজ শুরু করেছে। এতে পাইকারি পর্যায়ে দাম কমেছে। খুচরায় কেন কমেনি, সেটাও আমরা দেখছি। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করব।’
বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘এখন আমদানির অনুমোদন দিলে আমাদের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন। এটা আমরা করতে পারি না।’
দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬-২৭ লাখ টন। গত মৌসুমে উৎপাদিত হয়েছিল ৩৮ লাখ টনের কিছু বেশি। তবে উৎপাদন-পরবর্তী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে প্রতিবছর উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ শতাংশের বেশি নষ্ট হয়ে যায়। এতে মৌসুম শেষে আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয় এবং দামের ভারসাম্য রাখতে হয়।
সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শনিবার রাজধানীর বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হয়। এক সপ্তাহ আগে তা ছিল ৭০-৮০ টাকা।
পেঁয়াজের এমন চড়া দামের পেছনের কারণ হিসেবে সরকারের ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনও (বিটিটিসি) কৃত্রিম সংকটের কথা বলছে। তবে একই সঙ্গে দাম কমাতে তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে ‘স্বল্প পরিসরে’ আমদানির সুপারিশও করেছে। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া এক চিঠিতে কমিশন বলেছে, পেঁয়াজের বাড়তি দামের সুবিধা কৃষক পাচ্ছেন না। বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীরাই এর সুযোগ নিচ্ছেন। আমদানির সুযোগ দিলে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমে যাবে। তাতে ভোক্তারা যৌক্তিক দামে পেঁয়াজ কিনতে পারবেন।
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর ডিমের দাম প্রতি ডজন ১৫০ টাকা আর পেঁয়াজের দাম প্রতি কেজি ৯০ টাকা পেরোলে আমদানির অনুমতিসহ শুল্কছাড় দেওয়ার সুপারিশ করেছিল ট্যারিফ কমিশন।
চিঠিতে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল খান বলেছেন, কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কিছু মধ্যস্বত্বভোগী বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ এই সময়ে ৯০ টাকার মধ্যে থাকার কথা, কিন্তু তা বেড়ে এখন ১২০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের মতে, প্রতিবছর এই সময়টাতে পেঁয়াজের দাম বেশি থাকে। তাই আমদানি করতে হলে পরিকল্পনা আরও আগেই করার প্রয়োজন ছিল। তাহলেই দাম এই পর্যায়ে আসত না।
অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পর্যাপ্ত মজুত আছে বললেও আমাদের বাজারের চিত্র ভিন্ন। দাম কমাতে কিছু পেঁয়াজ আমদানি করা যেতে পারে।’