হোম > বিশেষ সংখ্যা

আলুকাহিনি ও ফরাসি সাংবাদিক

মইনুল হাসান, গবেষক

নাম ফিলিপ আলফঁনসি, বয়স তখনো ৩২ হয়নি। যেমন সুদর্শন, তেমনি মেধাবী এবং আপাদমস্তক ফ্যাশনসচেতন একজন মানুষ। প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে স্নাতক। পেশা ও নেশা সাংবাদিকতা। কাজ করতেন ফ্রান্সের একমাত্র টিভি চ্যানেলে।

১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করলে ফিলিপ এপ্রিলে ছুটে আসেন প্রায় ৫ হাজার মাইল বা ৮ হাজার কিলোমিটার দূরের ভারতে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের কথা বিশ্বকে জানাবেন, প্রথম সরকার গঠনের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হবেন আর ক্যামেরাবন্দী করবেন একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়ের বিরল চিত্র।

এপ্রিল, ১৯৭১। বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী মাথাভাঙ্গার তীরে চুয়াডাঙ্গা পরিণত হয়েছে বিরান প্রান্তরে। বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণে গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানিরা তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র, নিরীহ বাংলাদেশের মানুষের ওপর। নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নিরস্ত্র, নিরীহ বেসামরিক মানুষ। দিশেহারা অসহায় মানুষ প্রাণভয়ে দিগ্‌বিদিক ছুটছে। চরম ও বর্বর খুনের মত্ত উল্লাসে অন্ধ পাকিস্তানিরা সে সময় চুয়াডাঙ্গায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার চুয়াডাঙ্গাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করে, বর্বরতার সেটাই ছিল কারণ। ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কথা ছিল। পরে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শেষ মুহূর্তে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার বদলে তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় (বর্তমানে মুজিবনগর) সে শপথ অনুষ্ঠান করা হয়।

ফরাসি সাংবাদিক ফিলিপ আলফঁনসি ঠিক করলেন, নিজের চোখে যুদ্ধ দেখবেন, সঠিক খবর পৌঁছে দেবেন পৃথিবীর সব প্রান্তে। এমন সিদ্ধান্ত ছিল অনেকটাই দুঃসাহসিক। বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা তাঁকে নিরস্ত করতে চাইলে তিনি তা অগ্রাহ্য করেন। এপ্রিল মাসেই তিনি কলকাতা থেকে শরণার্থীদের পথ ধরে মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছে গেলেন। তিনি সেখানে পৌঁছানোর খানিক আগেই ওই এলাকায় প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের ঘটনা ঘটে। বহু মানুষ হতাহত হন।

বেশ কিছু অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অবস্থান নেন। সাংবাদিক ফিলিপ মাথাভাঙ্গা নদী পাড়ি দিয়ে চুয়াডাঙ্গায় পৌঁছাতে চাইলে মুক্তিযোদ্ধারা উদ্বিগ্ন হন। তাঁকে নিরুৎসাহিত করতে চাইলেন তাঁরা। ফিলিপ মোটেই দমে যাওয়ার পাত্র নন। তাঁকে ঝুঁকি নিতেই হবে। শেষে মুক্তিযোদ্ধারা রাজি হন। কিন্তু শর্ত জুড়ে দিলেন যে তাঁকে বাংলাদেশের ভিসা নিতে হবে। কারণ, পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। অন্য সব স্বাধীন দেশের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হলেও একজন ভিনদেশিকে যথারীতি ভিসা নিতে হবে।

পাসপোর্টে কীভাবে সিল দেওয়া হবে? ভিসা বা অন্য কোনো সরকারি কাজের জন্য তখন কোনো সিল তৈরি করাই হয়নি। একজন একটি বড় আকারের আলু নিয়ে এলেন। সেই আলু কেটে এবং খোদাই করে ভিসার জন্য সিল তৈরি করা হলো। কলমের কালি মেখে ফিলিপের ফরাসি পাসপোর্টের ওপর ভিসার সিল দিয়ে দেওয়া হলো। যথাযথ অনুমতি নিয়েই তিনি প্রবেশ করলেন সদ্য স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গায়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কমান্ড, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ড গঠিত হয়েছিল চুয়াডাঙ্গায়। মুক্তিযুদ্ধের ৮ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার্স ছিল চুয়াডাঙ্গা সদরের ৪ নম্বর ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে। বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটিও সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাক বিভাগ ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা এই জেলাতেই প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে নাকাল হয় এই চুয়াডাঙ্গায় এবং সেখানেই সংঘটিত হয়েছিল শতাধিক সম্মুখ যুদ্ধ।

ফিলিপ আলফঁনসি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে ধারণ করেন বহু মূল্যবান ভিডিওচিত্র।  মুক্তিযুদ্ধের এসব দুর্লভ ভিডিওচিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ। যুদ্ধের বিভীষিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের অসম সাহসিকতা সেখানে পুরোপুরি উপস্থিত। তাঁর সেসব সাহসী প্রতিবেদন টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর বিপুল সাড়া পড়ে যায় ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু দুঃসময়ে আলফঁনসি বাংলাদেশে আসেন ও ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধের কথা তুলে ধরেন। এর ফলে পরবর্তী সময়ে ফরাসি জনগণ ও সরকার বাংলাদেশের পক্ষ নেয়। দুঃসাহসী সাংবাদিক আলফঁনসির ধারণকৃত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিডিওচিত্র আজও বিশেষ যত্নে রক্ষিত আছে ফ্রান্সের জাতীয় সংরক্ষণাগারে।

আলফঁনসি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনে বহু দেশ ঘুরেছেন। বহু দেশের ভিসা রয়েছে তাঁর পাসপোর্টে। তারপরও সেই আলু কেটে বাংলাদেশের সিল দেওয়া ভিসা লাগানো পাসপোর্টটি পরম মমতায় বুকে আগলে ধরে রেখেছিলেন ৪৩ বছর। ২০১৪ সালে তিনি নিজে বাংলাদেশে গিয়ে তাঁর সেই পাসপোর্টটি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদান করেন।

ফিলিপ আলফঁনসি জন্মগ্রহণ করেন ফ্রান্সের জাতীয় দিবস, ১৪ জুলাই ১৯৩৯ তারিখে, প্যারিসে। জীবনবাজি রেখে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে কজন বিদেশি সাংবাদিক বিশ্বজনমত গঠনে অবদান রেখেছিলেন, তিনি তাঁদেরই একজন। একাত্তরের সেই ৩২ বছরের টগবগে তরুণ, আজ ৮২ বছর বয়স পার করেও সেই আলু দিয়ে তৈরি এক ঐতিহাসিক ভিসার কথা স্পষ্ট মনে রেখেছেন। আমাদের স্মৃতিতেও শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় অম্লান হোক মশিয়েঁ ফিলিপ আলফঁনসি, সেই আলুকাহিনি।

গ্রাহক অভিজ্ঞতা ও সন্তুষ্টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার

নিরাপত্তা ও সেবায় মার্কেট শেয়ারে এগিয়ে সিটি ব্যাংক

১৫০০‍-এর বেশি এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে সুবিধা দেয় ঢাকা ব্যাংক

মাস্টারকার্ডেই সহজ ও নিরাপদ লেনদেন

গ্রাহকের পছন্দের শীর্ষে ইসলামী ব্যাংকের খিদমাহ

লেনদেনে শীর্ষ স্থানই লক্ষ্য ইউসিবির

বিকাশ-এ ঈদ সালামি এখন আরও বর্ণিল

দাতা-গ্রহীতার দূরত্ব ঘুচিয়ে মানবতার মেলবন্ধন বিকাশ-এর ডোনেশন সেবায়

রমজানজুড়ে অনলাইন-অফলাইনে ঈদের সব কেনাকাটাই বিকাশ পেমেন্টে সঙ্গে থাকছে বিভিন্ন ডিসকাউন্ট ও ক্যাশব্যাক অফার

বিকাশ-এ পাঠানো রেমিটেন্স স্বস্তি এনেছে প্রবাসী ও স্বজনের জীবনে