১৯৭১ সালে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গিয়েছিল ১৯ নভেম্বর। ২০ নভেম্বর ছিল ঈদুল ফিতর। যুদ্ধের সেই ভয়াবহতার মধ্যে কেমন ছিল সেই ঈদ? মুক্তির গান যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, শিল্পীরা ট্রাকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান করতেন। তাঁদের সাহস দিতেন।
মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের দেশাত্মবোধক ও সংগ্রামী গান শুনিয়ে উজ্জীবিত করাকেই তাঁরা নিয়েছিলেন জীবনের ব্রত হিসেবে।
কিন্তু তাঁরা কেমন কাটিয়েছিলেন ঈদ? আসলে সেই দুর্বিষহ জীবনে ঈদ কীভাবে এসেছিল, কীভাবে তা কেটে গেছে, সে কথা অনেকেই মনে করতে পারেন না। মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় ছিলেন শিল্পী শাহীন সামাদ। তিনি বলছিলেন, ‘১৯৭১ সালের কোন মাসে কখন ঈদ এসেছিল মনে নেই। সে সময় ঈদ করার মতো মনের অবস্থা ছিল না। তখন আমাদের কেবল একটাই কাজ ছিল—জীর্ণ একটা ট্রাকে চড়ে ঝুঁকি নিয়ে মুক্তাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করা। তাঁদের প্রেরণা দেওয়া।
‘একবার এমনও হয়েছে, যশোর মুক্তাঞ্চলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যখন যাচ্ছি, অনেকেই বলছিল, ওদিকে যাবেন না, মাইন পোঁতা আছে। কিন্তু আমরা থামিনি। আমরা সেখানে গেলাম। যাওয়ার সময় এটা ভেবেই গিয়েছি যে, আর হয়তো ফিরব না। আবার এক জায়গায় গিয়েছি, সেখানে গান গেয়ে যেই ফিরে এসেছি, ওমনি সেখানে হানাদাররা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছে।’
এ রকম এক বাঁচা-মরার লড়াইয়ে কি সত্যিই ঈদের কথা ভাবা সম্ভব?
শিল্পী শারমিন মুরশিদ বললেন, ‘ঈদ আমার চেতনায় ছিল না। সময়টা এমন ছিল, চারপাশে রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। ভয়-আতঙ্ক। দেশ পরাধীন। যুদ্ধ চলছে। আমরা একটি দল মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরছি। গান শোনাচ্ছি। অন্যদের কথা জানি না, যুদ্ধরত বাংলাদেশে ঈদ কীভাবে এসেছিল, আমার মনে নেই। আমরা সেদিন কীভাবে কাটিয়েছি, ঈদ আসলে আমরা যেমনভাবে উদ্যাপন করে থাকি, যুদ্ধকালে তেমন হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না। সেই বন্ধুবান্ধব বা যাঁরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁরা আমাদের হয়তো ভালো বোধ করানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমার স্মৃতিতেই ছিল না ঈদ কবে এসেছিল। আমার সঙ্গে আরও যাঁরা ছিলেন, হয়তো তাঁদেরও মনে নেই সেই ঈদের কথা। তবে কারও কারও হয়তো নস্টালজিয়া ছিল। তাঁরা হয়তো ভেবেছেন আজ বাড়িতে থাকলে মায়ের হাতের সেমাই খেতাম। এই যুদ্ধদিনে সেটা পারছি না। ঈদটাকে যে উৎসব হিসেবে নেব, এমন ভাবনা মনে কাজই করেনি।’