পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই শতাব্দীর শুরুতে বললেন, নতুন শতাব্দীতে ঢাকা হবে বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থান। মন্তব্যটি নিয়ে পদে–বিপদে তখন বেশ আলোচনা হয়। বাংলাদেশেরও অনেকে খানিকটা হাস্যরস মিশিয়ে বলেন, সুনীলদা কি আতিথেয়তা আরও একটু বেশি চান নাকি! সে সময় শামসুর রাহমান থেকে রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী—সবাই বেঁচে আছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিভিন্ন সাহিত্যিক অনুষ্ঠান–আড্ডায় প্রায়ই ঢাকায় আসেন আর নানাভাবে ব্যাপক আপ্যায়িত হন। সেসব অনুষ্ঠান বা আড্ডার আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কথা বিভিন্ন পত্রিকায় নানাভাবে প্রকাশ পায়। ঢাকা বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থান হতে যাচ্ছে—এমন ভবিষ্যদ্বাণীকে অনেকেই তাই ‘কথার কথা’ বলে মনে করে থাকতে পারেন। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি শুধুই আড্ডা বা কথার কথা ছিল না। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের শুরুতে এসে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সেটাই হবে।
বাংলা সাহিত্য ইংরেজ আমলে কলকাতামুখী হয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণ কলকাতায় নগর গড়ে ওঠে এবং এর চেয়ে বড় কথা, সেটি রাজধানীর মর্যাদা পায়। কিন্তু তার আগে বাংলা সাহিত্য গড়ে ওঠে মূলত কলকাতার বাইরে। চর্যাপদের কথা যদি বাদও দিই, মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোর কোনো ধারা কলকাতাকেন্দ্রিক নয়, বরং মনসামঙ্গল একান্তভাবে পূর্ববঙ্গের সম্পদ; গীতিকা সাহিত্যও। চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, শিবমঙ্গল ইত্যাদি মধ্যযুগের প্রধান কোনো সাহিত্যিক ধারাই কলকাতাকেন্দ্রিক নয়। ইংরেজ আগমনের পরে সাহিত্য ধীরে ধীরে শহরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং তা বাংলার ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে কলকাতাকেন্দ্রিক। মূলত উনিশ শতক থেকে শহরকেন্দ্রিক সাহিত্যধারা চলে। সে হিসেবে এর বয়স ২২০ বছর অতিক্রম করেছে। এই ২২০ বছরের মধ্যে রাজনৈতিক উত্থান–পরিবর্তনে বাঙালির একচ্ছত্র ভূমিরেখা একাধিক খণ্ডে বিভক্ত হয়। বিশেষত ১৯৪৭–এর ভারতভাগের পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি মোট চারটি ভূখণ্ডে বিভক্ত হয় পড়ে। যে ভূখণ্ডগুলোর কম–বেশি পৃথক বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম। এই চার ভাগের বাইরেও বাঙালি রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং তারা আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্তও বটে। বাঙালির একচ্ছত্র বাসের বিবেচনায় বাংলাদেশ সর্বাগ্রে; এখানে বাঙালি জনসংখ্যা ১৬ কোটি। পশ্চিমবঙ্গে ১০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে সাড়ে আট কোটি বাঙালি। আর আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে দেড় কোটি বাঙালির বাস। ১৯৪৭–এর আগে কলকাতামুখো হওয়ার প্রবণতা সীমান্তবাধার জন্য স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে। আসাম আর ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গের আলোকরশ্মি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয় পড়ে। সেখানকার মানুষ ভারত দেশ হিসেবে এক পরিচয়ের হলেও জীবনযাপন ও ……. পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। আসাম ও ত্রিপুরার বাঙালিরা পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতার দিকে সাহিত্য–সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তাকিয়ে থাকে বটে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তাদের লালনও করে না, পাত্তাও দেয় না। সাহিত্যের ইতিহাস বইয়ে আসাম ও ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যের কোনো পরিচয় নেই, উপন্যাস সংকলনে বা কবিতা সংকলনে আসাম–ত্রিপুরা অথবা অন্যত্র রচিত ভালো লেখার কোনো সংযোজন দেখা যায় না। ভারতের বাঙালি ও তাদের সৃষ্টিতে এই সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরাও বেশ অস্তিত্বের সংকটে। বহুভাষী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ খানিকটা বেসামালই মনে হচ্ছে। তাই কখনো বাঙালি জাতীয়তাবাদী স্লোগান, কখনো জাতীয় ঐক্যের হস্ত সম্প্রসারণ ইত্যাদি দ্বন্দ্ব শিক্ষা–সংস্কৃতি–সাহিত্য থেকে তাদের রাজনীতিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। রজনীতিতে এসেছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, কিন্তু ইশতেহারে ঘোষণা করছে হিন্দি ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শত শত। এখানেই দ্বন্দ্বের চিত্রটা স্পষ্ট। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে নির্ভরতা রাখলে সর্বত্র বাংলা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হওয়া দরকার। হবে বাংলা মাধ্যমের বিদ্যালয়। কিন্তু করতে হচ্ছে হিন্দি ও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল। তরুণ প্রজন্মের তাহলে কী হবে? তা ছাড়া সাহিত্যও হয়ে পড়েছে এককেন্দ্রিক ও দুর্বল। পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু একটি সাহিত্য পত্রিকা দাঁড় করতে পারল না। নির্ভরতা সেই ‘দেশ’ পত্রিকা। কিন্তু ‘দেশ’ কি পড়ে যায়নি? শুধু সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক হয়েছে বলে নয়, ‘দেশ’ গুণ ও মান দুটোতেই আগের অবস্থায় নেই। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ রীতিমতো নির্লজ্জ ব্যবসাপত্রে পরিণত হয়েছে। শাসক দলের এতটা অনুগত হয়ে পত্রিকা প্রকাশের এটাও রেকর্ড নিশ্চয়! আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয় স্বল্প জায়গা নিয়ে আর রাজনৈতিক নেতাদের খুনসুটি নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন করে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। মানুষ এটা পড়েও। কারণ বিকল্প তৈরি করতে পারেনি অন্যরা। সাহিত্যে এখনো ‘দেশভাগ’ পশ্চিমবঙ্গে বড় বিষয়। ১৯৪৭ থেকে ৭৫ বছর চলে গেল, কিন্তু সেখানেও কোনো নতুন প্যারাডাইস তারা আনতে পারেনি। এ যুগের তরুণেরাও দেশভাগ নিয়ে লেখে, আলোচনা করে। এগুলোর বেশির ভাগই চর্বিতচর্বণ। কিন্তু এই সত্য এখনো কেউ বলে না, লেখেও না। লেখা-বলায় গেলেই ধরে। তবে পোড়নটা যে ভেতর থেকে লেগেছে, অল্প পরেই সেটা বোঝা যাবে নিশ্চয়।
সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবন প্রতিফলিত হলেই তা সেরা সাহিত্য হবে? না। ঠিক সেভাবে কথাটি বলা হয়নি। তবে সংখ্যার গুরুত্ব আছে এবং এর চেয়েও প্রশ্নবোধক হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনযাপনকে আলোচনায় রাখা। সেদিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনসাহিত্যে প্রাধান্য পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বৈকি! বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য শুধু সংখ্যার জোরেই অগ্রবর্তী, শুধু তা বলা হচ্ছে না। মানেও এগিয়ে। আসাম আর ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য যে আধুনিকতার লক্ষণ, তা বাংলা সাহিত্যের সার্বিক বিচারে সমান বা অগ্রবর্তী—এর কোনোটাই বলা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যের যে বাতাবরণ অতি সম্প্রতি গড়ে উঠেছে, তা আত্ম-আবিষ্কারের গহ্বরে প্রবিষ্ট। যেমন—সুন্দরবন ও সে অঞ্চলের মানুষ; বিহার সন্নিকটবর্তী অঞ্চল ও সেখানকার মানুষ; জঙ্গলমহালের জীবন ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন লেখকের প্রায় সিরিজ ধরে কথাসাহিত্য লেখা হচ্ছে। আর কবিকুল প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং নিমজ্জমান ‘দেশ’ তরীর যাত্রী। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতা ও কথাশিল্পে কিন্তু উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা পরিদৃশ্যমান। গত শতকের সাতের দশকের উল্লাসনির্ভর অগোছালো রচনা আটের দশকে স্থিতিশীলতার চেষ্টা, নয়ের দশকে ভালো লেখার সূচনা বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যকে নতুন পথ দেখিয়েছে। আজ নতুন শতকের তৃতীয় দশকে পরিমাণ ও মান দুই দিক থেকেই বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য অগ্রবর্তী এবং অন্য ভূগোলে অবস্থিত বাঙালির আগ্রহ কেড়ে নিয়েছে। বিশ্বব্যাপী নানা তাত্ত্বিক রসায়নে এ সাহিত্য তো জারিতই, উপরন্তু আত্মজিজ্ঞাসামুখর। যে পশ্চিমে একদা চোখ ফিরিয়েছিল নতুন উপাদানের সন্ধানে, পরে যখন বোঝা গেল, সেও তো এক মনোগত ঔপনিবেশিকতার টান—তখন সেই পশ্চিমও আর আগ্রহের কেন্দ্রভূমিতে থাকে না বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যের সারথিদের। তাঁরা প্রশ্ন করেন: ইংরেজরা না এলে কি বাঙালি আধুনিক হতো না? জীবনকে উদ্যাপন করতে পারত না? পশ্চিমের সবাই কি ভালো? মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাঙালিকে জীবনঘনিষ্ঠ হতে ডাক দিলেন গ্রিক-ল্যাটিন–ইংরেজির পাঠ নিয়ে; ঠিক। কিন্তু তার আগে যে চণ্ডীদাস বলে গেছেন: সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই—এর কি কোনো মূল্যায়ন হবে না? কিংবা লালন সাঁইয়ের আত্মজিজ্ঞাসা: সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে—এই জীবনদর্শন কি আলোচনার বাইরে থেকে যাবে? এইভাবে জিজ্ঞাসা আর আত্ম–অনুসন্ধানের পথ ধরে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য আজ পরিণামমুখী। স্বদেশের মাটিতে প্রোথিত আছে সার্বিক সাফল্যের চাবিকাঠি—এই মনোভাব আজ মূলে। পশ্চিমকে অস্বীকার নয়—সাঙ্গীকরণ এবং একই সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মানুষ ও সংস্কৃতিও আগ্রহের পরিধিতে এসেছে। তাই আফ্রিকা বা ল্যাটিন আমেরিকার সমাজ, সংস্কৃতি আর সাহিত্য বিশেষভাবে অধ্যয়নের সীমায়। বর্তমানের লেখককুল বিশ্বের সমস্ত উল্লেখযোগ্য সাহিত্যের পাঠ নেন, কিন্তু সৃজনের ক্ষেত্রে রাখেন বাংলা আর বাঙালির প্রাণসুতোটি। বিশ্বসাহিত্যের অনুস্মৃতি নয়, নিজের সাহিত্যকে বিশ্বে তুলে ধরে সেটিকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন করতে চান তাঁরা। এই চেতনাগত পরিবর্তনটি প্রধান হয়ে উঠেছে গত ৫০ বছরে। ধারাটি যদি অব্যাহত থাকে এবং সৃজনপ্রয়াসী লেখককুল যদি ছন্দ না হারান, তবে আশা করা যায়, ভারতভাগের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার আগেই বাংলা সাহিত্যের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির অধিবাস এই বাংলাদেশ!
সৌমিত্র শেখর
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়