আবারও অশান্ত জনপদে পরিণত হয়েছে খুলনা। ১৯৯৯-২০০৬ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে চরমপন্থী সংগঠনগুলো বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে একে অপরের ওপর খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়। খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সাম্রাজ্যের পতনের পর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) ভেঙে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল জনযুদ্ধ) বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিসহ একাধিক চরমপন্থী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময় দলীয় আধিপত্য ও চাঁদাবাজির ঘটনা নিয়ে প্রতিদিন একাধিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো। সন্ত্রাসীদের গুলি, বোমা হামলায় রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পরে র্যাব, পুলিশ, যৌথ বাহিনীর তৎপরতার কারণে ১৫ বছর অধিক সময় ধরে এ অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়। কিন্তু গত দেড় বছরে এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীরা ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ার পর খুলনায় ৯৫টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে শুধু শতকোটি টাকার মাদকের চালান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুন হয়েছে অর্ধশত। বর্তমানে আধিপত্য বিস্তার, মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে খুলনার ছয়টি সন্ত্রাসী বাহিনী।
যত হত্যাকাণ্ড
সূত্র জানায়, সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে নগরীর লবণচরা এলাকায় রাজু নামের এক সন্ত্রাসীকে মাদক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরপর ছয়টি গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। গুলিবিদ্ধ ওই যুবককে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাতেই ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। এর আগে রোববার রাতে খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা করিমনগর এলাকায় বাসায় ঢুকে স্ত্রীর সামনে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় সালাহ উদ্দিন ওরফে আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক মাদক কারবারিকে। একই রাতে নগরীর লবণচরা থানাধীন দরবেশ মোল্লা গলির একটি বাড়িতে নানি মহিদুন্নেছা (৫৫), নাতি মুস্তাকিম (৮) ও নাতনি ফাতিহাকে (৬) নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) রাশিদুল ইসলাম বলেন, খুলনায় মাদকের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে।
জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ আগস্ট থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত খুলনায় ৯৫টির ওপরে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা নগরীতে ৫০টি হত্যা মামলা হয়েছে, যা ৫ আগস্ট-পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এসব হত্যা মামলায় দেড় শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
খুনোখুনিতে ৬ গ্রুপ
বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, খুলনায় বর্তমানে ছয়টি সন্ত্রাসী গ্রুপ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনোখুনিতে লিপ্ত রয়েছে। এই গ্রুপগুলো হচ্ছে গ্রেনেড বাবুর বি কোম্পানি, চরমপন্থী হুমা বাহিনী, আশিক বাহিনী, পলাশ বাহিনী, নুর আজিম বাহিনী ও আরমান বাহিনী। এর মধ্যে আরমান এবং নুর আজিম কারাগার থেকে নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। আরমান বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সেকেন্ড ইন কমান্ড। কিছুদিন আগে প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত বিএনপির নেতা মাহবুবের নিকটতম আত্মীয় আরমান জেলে বসেই পার্টি নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে ওই সূত্রটি জানায়। এই ছয়টি বাহিনীপ্রধানের নির্দেশে চলে কিশোর গ্যাং।
সূত্র জানায়, ছয়টি সন্ত্রাসী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে খুলনায় মাসে অন্তত ৭০ থেকে ১০০ কোটি টাকার মাদক কারবার হয়। মাদকের এই বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রণে নিতে এসব বাহিনী প্রায়ই বিরোধে জড়ায়। এর মধ্যে মাদকের অর্ধেকের বেশি একাই নিয়ন্ত্রণ করেন গ্রেনেড বাবু। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, পাঁচ শতাধিক সদস্যের বাহিনী নিয়ে খুলনা ও আশপাশের এলাকায় মাদকের সিন্ডিকেট চালান গ্রেনেড বাবু। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ ১২ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রস্তুত করে পুরস্কার ঘোষণা করলে বেশির ভাগ সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হলেও গ্রেনেড বাবু ও আশিক ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।
৫ আগস্টের পর সন্ত্রাসীরা নিয়ন্ত্রণহীন
সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর মাদকের এই গডফাদাররা আত্মগোপনে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যে সন্ত্রাসে লিপ্ত হন। রাজনৈতিক গডফাদার না থাকায় ছয়টি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। একটি রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত এদের অপতৎপরতা রোধ করা অসম্ভব বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সন্ত্রাসীদের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র
৫ আগস্টের পর খুলনার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র এসেছে। তবে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হলেও বড় অস্ত্রগুলো রয়েছে তাদের হাতে। গত এক বছরে যৌথ বাহিনী ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুটি রাইফেল, পাঁচটি বিদেশি রিভলবার, বিদেশি পিস্তল ১৭টি, দেশি পিস্তল একটি, বন্ধুক একটি, কাটারাইফেল দুটি, পাইপ গান পাঁচটি, শাটারগান তিনটি ও তিনটি শটগান উদ্ধার করেছে পুলিশ।
অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) রাশিদুল বলেন, ‘জব্দ হওয়া বেশির ভাগ অস্ত্রেই “মেইড ইন ইন্ডিয়া” লেখা। সীমান্ত এলাকা কাছে হওয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমে মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিতে কিশোর গ্যাং ও উঠতি সন্ত্রাসীদের হাতে পৌঁছে গেছে মরণঘাতী এসব আগ্নেয়াস্ত্র। এসব অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান অব্যাহত আছে।’
হত্যাকাণ্ডে প্রশিক্ষিত ও পেশাদার লোক
কেএমপি কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে প্রশিক্ষিত ও পেশাদার লোক জড়িত। ঘটনা ঘটিয়ে তারা পালিয়ে যায়। তারপরও বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
জুলফিকার আলী হায়দার আরও বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। সবার সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন।’