বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে আইনজীবীদের দাবির মুখে ফৌজদারি মামলায় কারাগারে থাকা আসামিদের জামিন শুনানি ভার্চ্যুয়ালি হলেও বাকি সবই হচ্ছে অ্যানালগ পন্থায়। জামিননামা দাখিলসহ সব আবেদন আইনজীবীদের স্বশরীরে এসে জমা দিতে হচ্ছে। ফলে ভার্চ্যুয়াল আদালত ব্যবস্থার শুনানি ছাড়া বাকি সবই রয়ে গেছে অ্যানলগ দশায়।
করোনা মহামারির প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে গত তিন সপ্তাহ দেশে চলাচলে বিধিনিষেধ জারি রয়েছে। সময়ের সঙ্গে বিধিনিষেধ আরও কঠোর করা হয়েছে, যা মুখে মুখে লকডাউন হিসেবেই পরিচিত। এই লকডাউনে বন্ধ রয়েছে সরকারি অফিস–আদালত। আইনজীবীদের দাবির মুখে গত ১২ এপ্রিল থেকে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফৌজদারি মামলায় কারাগারে থাকা আসামিদের ভার্চ্যুয়ালি জামিন শুনানির নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। নির্দেশটি পরিপালন হলেও গোটা বিচারকাজের বাকি সবকিছুই রয়ে গেছে অ্যানালগ অবস্থায়।
ভার্চ্যুয়ালি জামিন শুনানির ব্যবস্থা করা হলেও জামিনের আবেদন, জামিননামাসহ অন্যান্য আবেদন দাখিল করতে হয় আইনজীবীদের স্বশরীরে উপস্থিত হয়েছে। ভার্চ্যুয়ালি শুনানির ব্যবস্থা ও আদালতের অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আদালতে ভিড় কমেছে—এটা সত্য। তবে যারা এসব আদেন জমা দিচ্ছেন তাঁদের ঠিকই ঝুঁকি নিয়ে হাজির হতে হচ্ছে।
সরেজমিনে ঢাকার আদালত ঘুরে দেখা গেছে, আদালতের গেটে বা সেরেস্তায় কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম নেই। হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হাত ধোয়ার জন্য সাবানের ব্যবস্থা পর্যন্ত নেই। অথচ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনায় দেশের প্রতিটি আদালতে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
ঢাকার আদালতের আইনজীবী লিটন চন্দ্র দাস বলেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপও কেউ নেয় না। তিনি বলেন, `জামিনের দরখাস্ত করতে আদালতে এসে আবেদন জমা দিতে হয়। অর্থাৎ, আইনজীবীকে মামলা করতে হলে স্বশরীরে আদালতে হাজির হতেই হয়। শুধু শুনানিটা ভার্চ্যুয়ালি হচ্ছে। এটাকে কি ভার্চ্যুয়াল আদালত বলে?’
এ বিষয়ে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, আদালতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করার কথা। সেটা মানতে হবে। এ বিষয়ে বারের পক্ষ থেকে থেকে আদালত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা হবে।
ভার্চ্যুয়াল শুনানি শুরুর পর জামিন মঞ্জুরের হার আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। এ বিষয়ে আইনজীবী শহীদুল ইসলাম বলেন, যাদের অপরাধের মাত্রা কম, তাঁদের জামিন দেওয়া হচ্ছে। আদালত খোলা থাকা অবস্থায় যাদের জামিন হয়নি, তাঁরাও জামিন পাচ্ছেন। আদালত অনেকটাই নমনীয়তা দেখাচ্ছেন এ ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, `শুধু জামিন নয়, গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু বিষয়ে শুনানি গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা দরকার ছিল।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষাপটে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শুধু ভার্চ্যুয়াল পরিসরে জামিন শুনানি নিয়ে বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। ভার্চ্যুয়াল এই আদালত ব্যবস্থা চালুর পর গত ছয় কার্যদিবসে চার হাজারের বেশি মামলার শুনানি হয়েছে। এই সময়ে কারাগারে থাকা ১২ হাজারের বেশি আসামি জামিন পেয়েছেন। তাঁরা এরই মধ্যে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন বলে সুপ্রিম কোর্টের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অনেক আইনজীবীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে নেওয়া এই বিশেষ ব্যবস্থা তুলে স্বাভাবিক কার্যক্রম চালুর দাবিও উঠেছে আইনজীবীদের একটি তরফ থেকে। সাধারণ আইনজীবী পরিষদের ব্যানারে কিছুসংখ্যক আইনজীবী এই দাবিতে সভা–সমাবেশও করছেন।
আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখা যায়, স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধের ফলে বহু আইনজীবী কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। অন্য অনেক পেশাজীবীর মতোই করোনা তাঁদের জন্য শাঁখের করাত হয়ে এসেছে। একদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি, অন্যদিকে আর্থিক সংকট।
এ অবস্থায় আজ বুধবার প্রধান বিচারপতির কাছে আদালতের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালুর আবেদন জানিয়েছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন ও সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী। তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালতের স্বাভাবিক কাজ চালুর আবেদন করেন। এতে নতুন মামলা রুজু, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে—এমন আসামিদের আদালতে আত্মসমর্পণের পর শুনানির ব্যবস্থা করার আবেদন জানানো হয়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক মমতাজ উদ্দীন আহমেদ বলেন, আইনজীবীরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমন পদক্ষেপের কারণে মামলাজট বাড়ছে। বিচারপ্রার্থীরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।