বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বগুড়ায় নেমে এসেছে গভীর শোক। জেলা বিএনপির কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের কান্নার রোল দেখা গেছে। শহরের অলিগলি, চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিরাজ করছে নীরবতা। কোথাও নেই স্লোগান বা রাজনৈতিক আলোচনা—শুধু স্মৃতিচারণা, দীর্ঘশ্বাস আর স্তব্ধতা।
যে শহর বারবার ভোটের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ করেছে, সেই বগুড়াই আজ হারাল তার বধূকে, তার নেত্রীকে, তার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য অধ্যায়কে।
খালেদা জিয়ার শ্বশুরবাড়ি বগুড়ার গাবতলী উপজেলায়। সময়ের সঙ্গে এই সম্পর্ক কেবল আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকেনি, হয়ে উঠেছিল আবেগের জায়গা। বগুড়ার মানুষ তাঁকে দেখেছে ঘরের বধূ হিসেবে, আবার দেখেছে দেশের নেতৃত্বে থাকা এক দৃঢ়চেতা রাজনীতিক হিসেবে।
তিনি বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭ আসন থেকে একাধিকবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে রেকর্ড ভোটে জয়লাভ করেন। প্রতিবারই ভোটের ব্যবধান ছিল উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনী রাজনীতিতে এমন ধারাবাহিক সাফল্য খুব কম নেতার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর একসময় নিভৃতচারী গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে নিতে হয় একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। সেখান থেকেই শুরু হয় তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলা। সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে টানা আন্দোলন, রাজপথের সংগ্রাম ও দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কঠিন দায়িত্ব সামলে তিনি হয়ে ওঠেন শক্তিশালী এক রাজনৈতিক প্রতীক। আপসহীন অবস্থানের কারণেই তিনি পরিচিত হন ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে। দীর্ঘ এই পথচলায় বগুড়া ছিল তাঁর নির্ভরতার জায়গা, একটি নিরাপদ ভোটব্যাংক।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে বগুড়ায় বিএনপির সব কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কালো পতাকা উত্তোলন, কোরআনখানি ও দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে। নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, এটি শুধু একজন নেত্রীর বিদায় নয়, এটি একটি যুগের সমাপ্তি। তবে শোক শুধু দলীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই; রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন—এমন অনেক মানুষও এই মৃত্যুতে আবেগাপ্লুত।
অনেকের স্মৃতিতে ভেসে উঠছে নির্বাচনী দিনের চিত্র। ভোটের আগে মিছিল, সভা আর মানুষের ঢল। খালেদা জিয়া যখন নির্বাচনী প্রচারে বগুড়ায় আসতেন, শহরের চেহারাই বদলে যেত। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকত লাখো মানুষ, এক ঝলক দেখার আশায়।
রাজনৈতিক জীবনে বিতর্ক, সংঘাত ও মামলার মধ্য দিয়েও যেতে হয়েছে তাঁকে। ক্ষমতায় থাকা ও না থাকার দুই সময়েই কারাবরণ, অবরুদ্ধ জীবন ও যোগাযোগহীনতা ছিল তাঁর বাস্তবতা। তবু বগুড়ার মানুষের কাছে তিনি ছিলেন সেই নারী, যিনি সব প্রতিকূলতার মধ্যেও মাথা নত করেননি।
মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলা বিএনপির কার্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় নেতা-কর্মীদের কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র রেজাউল করিম বাদশা এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন।
রেজাউল করিম বাদশা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কেবল আমাদের নেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন মায়ের মতো। বগুড়ার মানুষের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। তাঁর মৃত্যুতে আমরা সত্যিকার অর্থেই এতিম হয়ে গেলাম।’
ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘অসুস্থ অবস্থাতেও ম্যাডাম দলের ও দেশের মানুষের খোঁজ নিতেন। এই ক্ষতি কোনো দিন পূরণ হওয়ার নয়।’
মঙ্গলবার সকাল থেকেই শহরের নওয়াববাড়ি রোডে জেলা বিএনপির কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের ভিড় বাড়তে থাকে। জেলা বিএনপির উদ্যোগে মরহুমার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনায় শহরের বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল মসজিদে বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।