হোম > বিশ্লেষণ

ইউক্রেন যুদ্ধ: উদ্ধত পুতিনের ৫ ভুল আর পশ্চিমা ভণ্ডামি

ইউক্রেন যুদ্ধকে ন্যায্য প্রমাণ করতে রাশিয়া যা করছে, ঠিক সেই কাজগুলোই যুক্তরাষ্ট্র করেছে ইরাক ও আফগানিস্তানে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ঔদ্ধত্যের কারণে কখনোই অতীত থেকে শিক্ষা নেয় না। পুতিনও নেননি। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনে কয়েকটি ফ্রন্টে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। রাশিয়ার পিছু হটা এবং ‘প্রতিশ্রুত দ্রুত বিজয়’ বিলম্বিত হওয়ার কারণ হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে পাঁচটি মূল বিষয়ে পুতিনের ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভুল অনুমানকে’। 

প্রথমত, পুতিন দীর্ঘায়িত একটি যুদ্ধের জন্য রুশ সেনাবাহিনীর প্রস্তুতির বিষয়ে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন এবং বলপ্রয়োগ করে সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে রুশদের মনোভাব ভুলভাবে বিবেচনা করেছিলেন। ফলে তাঁকে তুলনামূলকভাবে সামরিক শক্তিতে ছোট কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এক শত্রুর বিরুদ্ধে ‘ব্যয়বহুল ও অপমানজনক’ সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। ইউক্রেনীয়রা যেখানে স্বেচ্ছায় দেশের জন্য আত্মত্যাগ করছে, সেখানে রুশ সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছে। এমনকি পারশিয়াল মোবিলাইজেশনেও যথেষ্টসংখ্যক সেনা জোগাড় করতে পারেনি রাশিয়া। 

পুতিনের দ্বিতীয় ভুল অনুমানটি হলো—তাঁর বিশ্বাস ছিল, কিয়েভ অল্প দিনেই আত্মসমর্পণ করবে। তিনি ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধস্পৃহা, স্বাধীনতার প্রতি তাদের অঙ্গীকারকে অবমূল্যায়ন করেছিলেন। ভেবেছিলেন, যেহেতু রাশিয়া ও ইউক্রেন একই অতীত ইতিহাস বহন করে, তাই ভবিষ্যতেও একই ধারা বহন করবে। কিন্তু বাস্তবে ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী অতীত থেকে মুক্তি চেয়েছে। এই যুদ্ধ ইউক্রেনীয়দের জাতীয় পরিচয়ের বিষয়ে যা-০ও বা সন্দেহ ছিল, তা চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়েছে। দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলেছে দারুণভাবে। এসব হতে পেরেছে অবশ্য পশ্চিমা সহযোগিতায়। 

পুতিনের তৃতীয় ভুল হলো, তিনি অনুমান করেছিলেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে ন্যাটো দুর্বল হয়েছে। তাঁর হিসাব ছিল, ইউক্রেনের ঘটনায় ন্যাটো ও পশ্চিমা জগতের প্রতিক্রিয়া আসবে ধীরে। তিনি আরও ধরে নিয়েছিলেন, রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর ইউরোপের অতিনির্ভরতার কারণে ইউক্রেন ইস্যুতে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে ভয় পাবে দেশগুলো। তবে তিনি ভুল ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাহসী মনোভাব এবং আক্রমণাত্মক রাশিয়ার বিষয়ে ইউরোপের ‘কটাক্ষ’ সম্মিলিতভাবে আটলান্টিক মহাগাসগের দুই প্রান্তকে আরও কাছে এনেছে। 

চতুর্থ ভুলটি হলো, পুতিন ধরেই নিয়েছিলেন আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্ষীয়মাণ। অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে দেশটি আরও দ্রুত ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং চীনের উত্থান ঠেকাতেই ব্যস্ত। তাই ইউক্রেনের বিস্তৃত-জটিল সংকটে যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় প্রতিক্রিয়া জানাবে। 

এখানেই বিষয়টি শেষ হলে ভালো হতো। পুতিন আরও একটি ভুল অনুমান করেছিলেন। সেটি হলো—২০০৮ সালে রাশিয়ার জর্জিয়া আক্রমণ, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার বিপরীতে বাইডেনের পূর্বসূরিরা যে নমনীয় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, পুতিন ভেবেছিলেন বাইডেনও সেই একই পথ অনুসরণ করবেন। কিন্তু তা হয়নি, বরং বাইডেন ইউক্রেনের আক্রমণকে মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং সম্মিলিতভাবে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গুত্বের পথে ঠেলে দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। 

অহংকারপ্রসূত স্বনির্বাচিত এসব অনুমানই পুতিনের সবচেয়ে বড় ভুল, যেখানে তিনি ব্যক্তিগত ও জাতীয় গর্বের দ্বারা তাড়িত হয়ে পতনশীল সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। এই যুদ্ধে পুতিন নির্মম একনায়ক হিসেবে নিজস্ব মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক নিয়মনীতিকে থোড়াই কেয়ার করেছেন। 

রাশিয়ার ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পেছনে একটি যুক্তি রয়েছে যে, পশ্চিম রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন আক্রমণ করা ছাড়া কোনো পথ খোলা রাখেনি। সেকারণে পুতিন যুদ্ধই বেছে নিয়েছেন। তিনি ভেবেছেন, ওয়াশিংটনের কথামতো কাজ করা ইউক্রেনীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা থেকে কোনো ফলাফল সম্ভব নয়। তাই তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার পরিবর্তে গ্রিক প্রবাদ—শক্তিমান যা খুশি তাই করে এবং দুর্বল কেবলই সহ্য করে—অনুসরণ করে দেশটিকে চূর্ণবিচূর্ণ করার পথে এগিয়ে গেলেন। ফলাফল, পুতিন ইউক্রেনে ঠিক সেই ভুলগুলোই করলেন, যেগুলোর জন্য তিনি অতীতে পশ্চিমকে অভিযুক্ত করেছেন। 

একই সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণের বিষয়েও আলোকপাত করা প্রয়োজন। পুতিন না হয় স্নায়ুযুদ্ধের ভূত দেখে ভীত হয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো আচরণ করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রও ধোয়া তুলসিপাতা নয়। ওয়াশিংটন পুতিনকে সামরিক হুমকি দিয়ে ইউরেশিয়াকে তটস্থ করে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। অথচ তারাই আবার এই অঞ্চলে ‘রঙিন বিপ্লবে’ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। ২০০৪ সালে খোদ ইউক্রেনেই অরেঞ্জ বিপ্লবে আগ্রহভরে সমর্থন দিয়েছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে ‘আরব বসন্তে’ দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ওয়াশিংটনের আচরণ ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। 

বাইডেন প্রশাসন রাশিয়াকে ইউক্রেনে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করে, কিন্তু তারাই যে ইরাকে এর চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল, যার ফলাফল এখনো স্থানীয়রা ভোগ করেই যাচ্ছে, তা বেমালুম ভুলে থাকে। বাইডেন কখনোই মার্কিন সিনেটর হিসেবে ইরাক যুদ্ধ সমর্থন করার জন্য ক্ষমা চাননি। তিনি এবং তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন বিশ্বাস করেছিল যে, যুদ্ধ দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। অথচ সেই যুদ্ধ চলেছে এক দশকেরও বেশি সময়। 

বাইডেন ইউক্রেন-সংকটকে গণতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্রের মধ্যকার লড়াই হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমর্থন পেতে বিশ্বের কিছু একনায়ককেও কাছে টানার চেষ্টা করছেন। ইউক্রেনের প্রতি তাঁর যতটা আগ্রহ; ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়ার অগণিত নিপীড়িতের প্রতি তার ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। রাশিয়া ইউক্রেনের চারটি অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পর পশ্চিমা বিশ্ব যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তার একাংশও দেখায়নি ইসরায়েলের ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার ভূমি দখলের সময়। স্বঘোষিত ইহুদি জাতীয়তাবাদী (জায়োনিস্ট) বাইডেন তাঁর পূর্বসূরি ট্রাম্প কর্তৃক জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের বিষয়েও কিছু বলেননি। কিছু বলেননি আরেক স্বঘোষিত জায়োনিস্ট ইংল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস একই ইস্যুতে ট্রাম্পের পদাঙ্ক অনুসরণের ঘোষণা দিলেও। 
 
এদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি ক্রমেই রাশিয়ার প্রতিকূলে চলে যাওয়ায় দেশটির সামনে কেবল অল্প কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগই অবশিষ্ট রয়েছে। হয় রাশিয়ার বিমানবাহিনীর ‘বিস্ময়কর সক্ষমতা’ প্রদর্শন করতে হবে, অথবা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে হবে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার হারের একটি ভয়াবহ দিকও রয়েছে। পরাজিত হলে রাশিয়ান ফেডারেশনে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আবারও মাথাচাড়া দিতে পারে। আফগানিস্তানে পরাজয়ের পর যেমন ভাঙন ধরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে। এবার পরিস্থিতি আরও গোলমেলে হতে পারে। 

সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভণ্ডামি আর অহংকারের একটি প্রবণতা হলো—এগুলো ব্যক্তিকে ধ্বংস করে ফেলে। অতীতে এ কারণেই বড় বড় সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে। শুনতে অবাক লাগতে পারে, রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই নিজেদের যুদ্ধকে ন্যায্য বলে প্রমাণ করতে গিয়ে একই ধরনের ভুলই বারবার করেছে। আমরা ইতিহাস থেকে জানি, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের পরিণতি কী। কারণ ইতিহাসবিদ থুকিদাইদিস আড়াই হাজার বছর আগেই পেলোপনেশিয়া যুদ্ধের বিষয়ে আমাদের জানিয়ে গেছেন এবং আমরা সেই যুদ্ধের পরবর্তী কয়েক হাজার বছর ধরে সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। 

এর পরও পরাশক্তিগুলো এমন ব্যয়বহুল ভুলের পুনরাবৃত্তি করে কীভাবে সেখান থেকে নতুন ফলাফল আশা করে? তবে কি ঔদ্ধত্য পাগলামিরও জন্ম দেয়? সে যাই হোক, মনে রাখতে হবে, বুদ্ধিমানেরা শেখে নিজের ভুল থেকে এবং জ্ঞানীরা শেখে অন্যের ভুল দেখে। কেবল বোকারাই কারো থেকেই শিক্ষা নেয় না, যেমনটা এখন দেখছি ইউক্রেনে। 

মারওয়ান বিসারার নিবন্ধ। আল-জাজিরার থেকে ভাষান্তর আব্দুর রহমান

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

কোন দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বাধিক, বাংলাদেশের চিত্র কেমন

যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা দক্ষ ইতালির জঙ্গি বিমান ইউরোফাইটার টাইফুন

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত থামেনি, ট্রাম্প ‘থামিয়েছেন’ দাবি করা অন্য যুদ্ধগুলোর কী অবস্থা