যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহের ক্ষেত্রে একটি বিতর্কিত মডেলের ব্যবহার এবং তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সামরিক কর্মীদের একটি সংস্থার জড়িত থাকার ঘটনা বিশ্বজুড়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইউজি সলিউশনস’ নামের একটি সংস্থা, যারা নিজেদের একটি ‘মহান উদ্দেশ্যে পরিচালিত মানবিক লজিস্টিকস ও হুমকি মূল্যায়ন সংস্থা’ হিসেবে পরিচয় দেয়, তারা বর্তমানে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজ করছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির হাতে আসা ড্রোন ফুটেজে দেখা গেছে, উর্দি থেকে সামরিক প্রতীক সরিয়ে ফেলা হলেও রাইফেল হাতে থাকা সাবেক মার্কিন সেনারা স্থানীয় কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং সাঁজোয়া ট্রাক থেকে বিশাল আকারের খাবারের কার্টন নামাচ্ছেন।
জিএইচএফের এই সামরিকীকৃত ত্রাণ মডেলটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ১৫০টির বেশি মানবিক সাহায্য সংস্থা, যার মধ্যে অক্সফাম ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও রয়েছে, তারা তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, এই ফাউন্ডেশন ‘মূল মানবিক মানদণ্ড মেনে চলে না’। তাদের মতে, আগে যেখানে ৪০০টি সাধারণ ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র ছিল, সেগুলোকে প্রতিস্থাপন করে মাত্র চারটি সামরিকীকৃত বিতরণ সাইট স্থাপন করায় লাখ লাখ মানুষ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) এই এলাকাগুলোকে ‘মানবিক সহায়তার মুখোশে গণহত্যা’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জিএইচএফ পরিচালিত ত্রাণ বিতরণের এই এলাকাগুলোতে বহু হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ড্রপ সাইটের রিপোর্ট অনুযায়ী, মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ইউজি সলিউশনসের নিরাপত্তা চলাকালে ত্রাণ বিতরণের স্থানগুলোর কাছাকাছি ইসরায়েলি বাহিনী বা নিরাপত্তা ঠিকাদারদের হাতে ২ হাজার ৬০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৯ হাজারের বেশি আহত হয়েছে।
ইউজি সলিউশনস দাবি করে, তারা কোনো প্রাইভেট মিলিটারি কন্ট্রাক্টর (পিএমসি) নয়, বরং নিরাপত্তা ও মানবিক সাহায্য সরবরাহের মধ্যে একটি ‘সেতু তৈরি’ করছে। সংস্থাটি আসলে মার্কিন শিশু পাচারবিরোধী অলাভজনক সংস্থা ‘দ্য সেন্টিনেল ফাউন্ডেশন’ থেকে জন্ম নিয়েছে। সেন্টিনেলের কর্মীরা বেসরকারি খাত থেকে একের পর এক প্রস্তাব পেতে শুরু করলে তাঁরা আলাদা সংগঠনই খুলে ফেলেন। ফলে, সংস্থাটিতে সাবেক মার্কিন সামরিক কর্মীদের একটি বড় অংশ রয়েছে।
ইউজি সলিউশনসের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সেনাদের একটি কোম্পানি এটি, যা বৃহত্তর কল্যাণে কাজ চালিয়ে যেতে চায়। ইউনিফর্মে বহু বছর কাটানোর পর সংস্থাটির কর্মীদের সংঘাতপূর্ণ ও সংঘাতপরবর্তী এলাকায় কাজ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু কঠিন সময়ে মানুষকে সাহায্য করার প্রেরণা তাদের সব সময় তাড়া করে। তাই কোম্পানিটি কেবল নিরাপত্তা ঠিকাদার হিসেবে কাজ না করে নিরাপত্তা ও মানবিক কাজের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করছে।
ইউজি সলিউশনসের সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগটি আসে বিবিসির একটি অনুসন্ধানে। এতে জানা যায়, গাজায় মোতায়েন করা ৩২০ জন ঠিকাদারের মধ্যে কমপক্ষে ৪০ জন ‘ইনফিডেলস মোটরবাইক ক্লাব’ নামের একটি মার্কিন বাইকার গ্যাংয়ের বর্তমান বা সাবেক সদস্য, যারা প্রকাশ্যে নিজেদের ‘আধুনিক ক্রুসেডার’ সংস্থা হিসেবে প্রচার করে। তারা নিয়মিত অনলাইনে মুসলিমবিদ্বেষী কনটেন্ট পোস্ট করে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্যাংয়ের অন্তত ১০ জন সদস্য গাজায় ইউজি সলিউশনসের হয়ে কাজ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন গাজা কান্ট্রি টিম লিডার জনি ‘ট্যাজ’ মালফোর্ড (যাঁর শরীরে ক্রুসেডার ‘ক্রস’ ও ‘১০৯৫’ ট্যাটু), ইনফিডেলস এমসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ল্যারি ‘জে-রড’ জ্যারেট (লজিস্টিকসের দায়িত্বে) এবং গ্যাংয়ের জাতীয় কোষাধ্যক্ষ বিল ‘সেন্ট’ সিব (একটি বিতরণ কেন্দ্রের সিকিউরিটি প্রধান)।
সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে গ্যাং সদস্যদের রাইফেল হাতে পোজ দিতে এবং ‘মেক গাজা গ্রেট অ্যাগেইন’ লেখা ব্যানার প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
একাধিক সাবেক ঠিকাদার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কিছু মার্কিন কর্মী ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ‘জম্বি হোর্ডস’ বলে উল্লেখ করতেন। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদনে গোলাগুলি ও বিশৃঙ্খলার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে একজন গার্ড ১৫ রাউন্ড গুলি চালানোর পর অন্যজন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, ‘হেল, ইয়া, ডুড!’ এ ছাড়া সাবেক ইউএস স্পেশাল ফোর্সের ভেটেরান অ্যান্টনি আগুইলার হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কোম্পানির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার মতো গুরুতর অভিযোগ করেছেন।
অবশ্য ইউজি সলিউশনস এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, প্রত্যেক কর্মীকে কঠোর ব্যাকগ্রাউন্ড চেক ও পেশাদার মান পূরণ করেই মোতায়েন করা হয়েছে।
ইউজি সলিউশনসের গাজা মিশনের সবচেয়ে সংবেদনশীল দিকটি হলো, হামাস ও ইসরায়েল (আইডিএফ) উভয়ের সঙ্গে কাজ করা। সংস্থাটি দাবি করেছে, যখন তারা চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসআরএসের ঠিকাদার হিসেবে গাজায় পৌঁছায়, তখন যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী ইসরায়েল সরকার এবং হামাস উভয়েই তাদের ভূমিকাকে অনুমোদন করেছিল।
তারা ‘ব্যাটলস্পেস ওনার’ আইডিএএফের সঙ্গে চলাচল এবং সংঘাত এড়ানোর ক্ষেত্রে সমন্বয় করত। আর ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত এলাকার বাইরের বিষয়গুলোতে মিসরীয় নিরাপত্তা পেশাদারদের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে সমান্তরাল সমন্বয় ছিল।
ইউজি সলিউশনস আরও দাবি করেছে, জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণের মডেলটি হামাসের খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ উপার্জনের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছিল, যার ফলে হামাস জিএইচএফের স্থানীয় কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করে।
ইউজি সলিউশনস দাবি করেছে, তারা সেফ রিচ সলিউশনস (এসআরএস) ও জিএইচএফের সঙ্গে যৌথভাবে ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ তৈরি করেছে, যাতে জেনেভা কনভেনশনের কোনো লঙ্ঘন না ঘটে।
তারা ভিড় নিয়ন্ত্রণের জন্য অ-প্রাণঘাতী সরঞ্জাম যেমন: বুলহর্ন, সাউন্ড গ্রেনেড (শব্দ সৃষ্টিকারী, কোনো প্রাণঘাতী ক্ষমতা নেই) এবং পেপার স্প্রে ব্যবহার করে।
প্রত্যেক নিরাপত্তাকর্মীর জন্য একটি রাইফেল (এম-৪) ও একটি পিস্তল বরাদ্দ আছে। সংস্থাটি দাবি করে, একটি ‘বিনা মূল্যের খাবারের বক্সের’ জন্য কাউকে গুলি করা উচিত নয় এবং তাদের কর্মীরা কেবল নিজেদের জীবন বিপন্ন মনে হলেই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন।
তবে, একাধিক সাবেক ঠিকাদার জানিয়েছেন, ভিড় যখন জিএইচএফ বিতরণ গেটের দিকে এগিয়ে আসত, তখন তাদের প্রাণঘাতী অস্ত্র চালানোর জন্য উসকানি দেওয়া হয়েছিল।
গাজা পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে ‘শিল্প ও অবকাঠামো সুরক্ষার’ জন্য তারা কাজ করতে প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে ইউজি সলিউশনস।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, জেটিও, এনডিটিভি