হোম > বিশ্লেষণ

সংক্রমণের চূড়া ছুঁতে চলেছে বাংলাদেশ

জাহাঙ্গীর আলম

করোনায় সংক্রমণ ও মৃত্যু অব্যাহতভাবে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। আজ সোমবার একদিনে সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৯ হাজার ৯৬৪ জনের এবং সে হিসাবে সংক্রমণ হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। মোট সংখ্যা এবং হারের দিক থেকেও এটি একদিনে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ ও ভারতের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছানোর পথে। দুই দেশেই দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট। 

গতকাল রোববার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) জিনোম সিকোয়েন্স প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, এপ্রিল মাসেও দেশে সংক্রমিতদের মধ্যে বিটা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য ছিল। এপ্রিলে দেশে প্রথম ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এ ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের হার বাড়তে থাকে। এ ভ্যারিয়েন্ট মে মাসে ৪৫ শতাংশ ও জুন মাসে ৭৮ শতাংশ নমুনায় শনাক্ত হয়। বর্তমান সংক্রমণে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য সুস্পষ্ট। 

বাংলাদেশে গত ফেব্রুয়ারিতেও সংক্রমণ হার ৩ শতাংশের নিচে ছিল। দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় মার্চে। এর মধ্যে একবার সংক্রমণ সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশে (৫ এপ্রিল) ওঠার পর ক্রমেই কমতে থাকে। এপ্রিলে প্রথম ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়। এর পর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ আবার বাড়তে শুরু করে। 

এ সময় বিশেষ করে সীমান্ত এলাকায় হঠাৎ করে সংক্রমণ অস্বাভাবিক বাড়তে থাকে। তড়িঘড়ি করে ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় সরকার। যদিও এর মধ্যে ভারত থেকে অনেকেই দেশে ফিরেছেন এবং তাঁদের মধ্যেই প্রথম ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। সর্বশেষ আজ সোমবার একদিনে সর্বোচ্চ শনাক্ত হার ২৯ দশমিক ৩০ শতাংশ বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এ ছাড়া এদিন একদিনে সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে অধিদপ্তর। 

অপরদিকে ভারতে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় গত বছরের সেপ্টেম্বরে। দেশটিতে প্রথম ঢেউয়ে সংক্রমণ শীর্ষে ছিল ওই মাসেই। এর পর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় চলতি বছরের এপ্রিলে। সংক্রমণ শীর্ষে ওঠে ২৫ এপ্রিল, হার ছিল ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বর্তমানে সংক্রমণ হার ৩ শতাংশের নিচে। 

দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেশি ভুগেছে ভারতের দিল্লি ও মহারাষ্ট্র রাজ্য। ২২ এপ্রিল দিল্লিতে সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ সংক্রমণ হার দেখা গিয়েছিল। সেখানে এখন সংক্রমণ হার ১ শতাংশের নিচে। 

গত ২১ সেপ্টেম্বর মহারাষ্ট্রে সর্বোচ্চ ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ শনাক্ত হয়। এর পর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ৪ এপ্রিল এ হার ছিল ২৯ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে এ রাজ্যেই করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট প্রথম শনাক্ত হয়। 

আর দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত ২৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গে সর্বোচ্চ শনাক্ত হার দেখা যায় ৩২ দশমিক ৯ শতাংশ। সেখানে এখন সংক্রমণ হার ৩ শতাংশের নিচে। সে হিসাবে বলা যায়, দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের চূড়া ছুঁতে চলেছে বাংলাদেশ। প্রতিদিন যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে শিগগিরই চূড়া ছুঁয়ে ফেলবে বলে ধারণা করা যায়। 

তবে গত বছরের ৮ মার্চে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের কথা ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত সংক্রমণের লেখচিত্র দেখলে প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ দেশে বেশি দিন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। যদিও লেখচিত্রে কাছাকাছি কমপক্ষে তিনটি তরঙ্গ দেখা যাচ্ছে। 

এ পরিস্থিতির জন্য সরকারের বিধিনিষেধ বা লকডাউন কার্যকর কৌশলকেই সব সময় দায়ী করে এসেছেন বিশেষজ্ঞরা। কোভিড–১৯ মহামারি মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি বারবার টানা কমপক্ষে ১৪ দিনের বিধিনিষেধ বা লকডাউন দেওয়ার কথা বলে এসেছে। কিন্তু সরকার বারবারই সাত দিন করে বিধিনিষেধ দিয়েছে। সেটিও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ নিয়ে কারিগরি কমিটি একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছে। 

অথচ সংক্রমণ বিস্তার পরিস্থিতি বুঝতে ১৪ দিন অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয়। কারণ, নভেল করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল ১৪–২১ দিন বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। 

চলতি বছর ৫ এপ্রিল থেকে বিধিনিষেধ দিতে শুরু করে সরকার। তবে কখনোই লকডাউন সেভাবে কার্যকর হয়নি। কারখানা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। দলে দলে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছে। বিশেষ করে ফেরিঘাটগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। এর পর পরিবহন শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে সরকার গণপরিবহন চালু করেছে। বারবার বিধিনিষেধের মেয়াদ বাড়ানো হলেও ধাপে ধাপে শিথিল করা হয়েছে। সীমান্তে মানুষের যাতায়াত চলেছে। অথচ মে মাসেও সংক্রমণ হার ৭ শতাংশের ওপর ছিল। সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ১ জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। সেটি আজ ১৪ জুলাই পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। 

সর্বোচ্চ সংক্রমণ হারের দিক থেকে কিন্তু বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়েই। প্রথম ঢেউয়ে সর্বোচ্চ ৩২ শতাংশ শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের ৩ আগস্ট। সেখানে ভারতে গত বছরের ১৯ জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে প্রথম ঢেউয়ে সর্বোচ্চ শনাক্ত ছিল ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ। অবশ্য জনসংখ্যার আকার এবং নমুনা সংগ্রহ ও ল্যাব অবকাঠামো সুবিধাটিও এখানে বিবেচ্য। এরপরও বলা যায়, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি সে অর্থে কখনোই নিয়ন্ত্রণে ছিল না। 

ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট সারা বিশ্বেই এখন আতঙ্ক তৈরি করেছে। এ ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ সক্ষমতা অনেক বেশি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার এখন লকডাউন বর্ধিত করার পাশাপাশি গণটিকা কার্যক্রম বেগবান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ হার ৪ শতাংশের নিচে না নামা পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা ঠিক হবে না।

সরকার আগামী ১৪ জুলাই পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের মেয়াদ বাড়িয়ে এই পরামর্শ গ্রহণের বার্তা দিয়েছে। লকডাউন বাস্তবায়নে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও সে সাক্ষ্যই দিচ্ছে। তারপরও ‘কিন্তু’ থাকছে। কিন্তুটি জনজীবন নিয়ে। কঠোর লকডাউন আরোপের পর গত কয়েক দিনে বিশেষত নিম্নবিত্ত মানুষের নানা সংকট নানাভাবে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে এসেছে। করোনার মতো এও এক বাস্তবতা। অর্থনীতির আকার বড় হলেও সাধারণ মানুষকে আর্থ–সামাজিক সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে এর সক্ষমতা না বাড়ায় এই সংকট এতটা তীব্র হয়েছে। সরকার নানা সহায়তাও দিচ্ছে। কিন্তু এটি সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ অবস্থায় সংক্রমণের চূড়ার কাছে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও সরকারি–বেসরকারি অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়কে শুধু কথায় নয়, মাঠে বাস্তবায়ন দেখাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!