হোম > বিশ্লেষণ

ট্রাম্পের হাতে মাদুরোর পতন রাশিয়া ও সৌদি আরবকে যেভাবে বিপদে ফেলবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

চলতি বছরের শুরুর দিকে মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। ছবি: এএফপি

ভেনেজুয়েলায় রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড-এর নেতৃত্বে একটি বিশাল সামরিক বহর ক্যারিবীয় সাগরে মোতায়েন করা হয়েছে। এই রণতরী বহর যে কোনো মুহূর্তে ভেনেজুয়েলায় সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত রয়েছে।

ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলায় সক্রিয় মাদক কার্টেলগুলোকে ‘ধ্বংস’ করার লক্ষ্য স্পষ্ট জানালেও, প্রশ্ন উঠেছে সামরিক আঘাত কি কেবল মাদক দমন অভিযানে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি তা সরাসরি নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে উৎখাত করার পূর্ণাঙ্গ সামরিক উদ্যোগে রূপ নেবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা সীমিত করতে কংগ্রেসের ‘ওয়ার পাওয়ারস রেজোলিউশন’ প্রয়োগের প্রচেষ্টা গত বৃহস্পতিবার নিম্নকক্ষে ব্যর্থ হওয়ায়, ট্রাম্পের হাতে এখন সব ধরনের সামরিক পদক্ষেপের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে। যদিও ট্রাম্প বলেছেন, ভেনেজুয়েলায় সামরিক অভিযানের সম্ভাবনা কম।

সামরিক বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, পূর্ণাঙ্গ স্থল আক্রমণের সম্ভাবনা কম। তবে মার্কিন নৌ ও বিমান শক্তি দেশটির অভ্যন্তরীণ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে মাদুরোর সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই কৌশলগত অবস্থান মাদুরো সরকারের ওপর চূড়ান্ত চাপ সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিকোলাস মাদুরোর শাসনাধীন ভেনেজুয়েলার জনগণ দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে চান ভেনেজুয়েলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ। এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মারিয়া করিনা মাচাদো মাদুরো শাসনের বিরুদ্ধে পরিবর্তন আনার জন্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অবশ্য সর্বশেষ নির্বাচনের পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে মাচাদো ট্রাম্প প্রশাসনের সামরিক উদ্যোগকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। মাদুরো-বিরোধীরা আশা করছেন, মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনী, সম্ভবত কিছু গোপন স্থল বাহিনীর সহায়তায়, অভ্যন্তরীণ বিরোধীদের সঙ্গে মিলে মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। তখন মাচাদোর নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠানের দুয়ার খুলে যাবে।

ভেনেজুয়েলা সংকটের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বের জ্বালানি মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার মতো তেলসম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসন (ইআইএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার প্রমাণিত তেলের মজুত ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল, যা বিশ্বের মধ্যে সর্ববৃহৎ। দেশটির মজুত সৌদি আরবের (২৬৭ বিলিয়ন ব্যারেল) এবং ইরানের (২০৮ বিলিয়ন ব্যারেল)-এর থেকেও বেশি।

কিন্তু সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ-এর সময়ে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও সরকারি কিছু অদক্ষতার কারণে দেশটির একসময়কার বিশ্বের অন্যতম লাভজনক তেল শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে। বর্তমানে ভেনেজুয়েলা তেল উৎপাদন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে এবং রপ্তানি করে বছরে মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অথচ সৌদি আরব বছরে প্রায় ১৮০ বিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়া ১২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল রপ্তানি করে থাকে। এই বিপুল সম্পদ যদি সমাজতান্ত্রিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক নতুন ঢেউ আনবে।

যদি মাদুরোর শাসনের পতন হয় এবং মার্কিন সরকারের পূর্ণ সমর্থন থাকে (নিশ্চিতভাবে তা থাকবে), তবে তেল শিল্প দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং একই সঙ্গে ধসের মুখেও পড়তে পারে। ২০ বছর আগেও ভেনেজুয়েলা দৈনিক ৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদুরোর পতন হলে খুব দ্রুতই দেশটি সেই স্তরে ফিরে যেতে পারে।

এই বিপুল পরিমাণ তেল যদি বাজারে আসে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি ভেনেজুয়েলাকে ওপেক-এর বাইরে রাখতে চান (অতি অবশ্যই রাখবেন), তাহলে তেলের দাম মারাত্মকভাবে কমবে। বিশ্লেষকদের ধারণা, ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ৫০ ডলারের নিচে নেমে যেতে পারে, এমনকি ৩০ ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই মূল্যপতন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় যে তিনটি পরিণতি নিয়ে আসবে সেগুলো হলো:

সংকটে পড়বে ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া: তেলের দাম কমলে রাশিয়ার তেল বিক্রি থেকে রাজস্ব মারাত্মকভাবে কমে যাবে। ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারে বিক্রি হলে, রাশিয়া তাদের ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করতে পারবে না। বিশ্ববাজারে ভেনেজুয়েলার সস্তা তেল সহজলভ্য হলে, নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রাশিয়ার তেল কেনার আগ্রহ আরও কমে যাবে।

সৌদি আরবের ওপর চরম আর্থিক চাপ: কম তেলের দামের কারণে সৌদি আরবও বিশাল আর্থিক চাপের মুখে পড়বে। এখনই দেশটির বাজেট ঘাটতি বাড়ছে; তেলের রাজস্ব কমে গেলে এই সংকট আরও গভীর হবে এবং যুবরাজ তাঁর স্বপ্নের প্রকল্পে ব্যয় কমাতে বাধ্য হবে।

বিশ্ব অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি: তেল রপ্তানিকারকদের ক্ষতি হলেও, বিশ্বের বাকি অর্থনীতির জন্য ক্রমহ্রাসমান তেলের দাম অত্যন্ত সহায়ক। এর ফলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে, মানুষের হাতে অন্যান্য জিনিসের জন্য বেশি অর্থ থাকবে এবং তা বিশ্ব অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে উদ্দীপিত করবে।

তবে এই সামরিক পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যায়, বা হোয়াইট হাউস হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নেবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত। কিন্তু যদি এই অভিযান সফল হয়, তবে এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে নাটকীয় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে।

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!