আধুনিক বিচার ব্যবস্থায় মৃত্যুদণ্ড বা প্রাণদণ্ড সম্ভবত সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত একটি বিষয়। এই শাস্তি কেবল দেশ বা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করেনি, বরং বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের মনেও গুরুতর নৈতিক ও আইনি প্রশ্ন জাগিয়ে তুলেছে। যদিও অনেকে মনে করেন মৃত্যুদণ্ড অপরাধের প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অপরিহার্য, তবে মানবাধিকার কর্মী ও এই বাধান বিলোপের পক্ষে থাকা অধিকারকর্মীরা বিরুদ্ধে পাঁচটি মূল কারণ তুলে ধরেছেন।
তাঁদের বিরোধিতার মূল কারণগুলো মূলত পাঁচটি আন্তঃসম্পর্কিত যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত:
১. নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড: ভুল সংশোধনের সুযোগ না থাকা
বিলোপবাদীদের মতে, এটিই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তি। পৃথিবীর কোনো বিচার ব্যবস্থাই শতভাগ নির্ভুল নয়। মানুষের তৈরি এই সিস্টেমে ভুল হতেই পারে, কিন্তু মৃত্যুদণ্ড সেই ভুলকে চিরস্থায়ী করে দেয়।
ভুলের দৃষ্টান্ত: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিক যুগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে অন্তত ৪ শতাংশ নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। ১৯৭৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০-এরও বেশি ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর নির্দোষ হিসেবে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই দৃষ্টান্ত বিচার ব্যবস্থার ত্রুটির হারকে প্রকটভাবে তুলে ধরে।
এই শাস্তির ফলাফল: ভুল করে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি মুক্তি পেলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সুযোগ পায়, কিন্তু একবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলে সেই ভুল শুধরে নেওয়ার কোনো উপায় থাকে না। জীবনের বিনিময়ে এমন ঝুঁকি নেওয়া কোনো সভ্য সমাজের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়।
২. মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন
বহু মানুষের কাছে, মৃত্যুদণ্ড হলো জীবনের মৌলিক অধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-সহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা মৃত্যুদণ্ডকে চরম নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক শাস্তি হিসেবে দেখে। বছরের পর বছর ধরে ‘মৃত্যু-মিছিলের’ অপেক্ষায় থাকা আসামির মানসিক যন্ত্রণা এক ধরনের নির্যাতন হিসেবেও বিবেচিত।
এ ছাড়া সমালোচকেরা যুক্তি দেন, যে সহিংসতা বা হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্র নিন্দা জানায়, সেই একই সহিংসতা যখন রাষ্ট্র নিজে অনুমোদন করে, তখন বিচার ব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. পদ্ধতিগত পক্ষপাত এবং বৈষম্যমূলক প্রয়োগ
দেখা গেছে, মৃত্যুদণ্ড প্রায়শই সমাজের দুর্বল এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। বহু দেশে আসামির আর্থসামাজিক অবস্থা বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির বর্ণের ওপর ভিত্তি করে মৃত্যুদণ্ড বেশি কার্যকর হতে দেখা যায়। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা বা অভিজ্ঞ আইনি সহায়তা নিতে অক্ষম ব্যক্তিরা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এ ছাড়া বুদ্ধিবৃত্তিক বা মনো-সামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনেক সময় ন্যায্য বিচার পাওয়ার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়, যা রায়কে স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রতীয়মান করে।
৪. অপরাধ দমনে প্রতিরোধক প্রভাব কম
মৃত্যুদণ্ডের প্রবক্তারা প্রায়শই অপরাধ প্রতিরোধের যুক্তি তুলে ধরেন। অর্থাৎ, তাঁরা মনে করেন মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে মানুষ আর সেই অপরাধ করার সাহস পাবে না। এতে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। কিন্তু আধুনিক অপরাধবিজ্ঞান গবেষণা এই দাবিকে সমর্থন করে না।
দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অপরাধ দমনে বেশি কার্যকর—এমন কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনকি কিছু বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যে দেশগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, সেখানে হত্যার হার তুলনামূলকভাবে বেশি।
এ ছাড়া বেশির ভাগ গুরুতর অপরাধ হয় আবেগের বশে, মানসিক চাপের মধ্যে, অথবা নেশার প্রভাবে সংঘটিত হয়। এই ধরনের ক্ষেত্রে অপরাধী শাস্তির কথা যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করে না।
৫. সহিংসতা ও ট্রমার চক্র
অনেকে মনে করেন, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা কেবল প্রতিশোধের ধারণাকেই প্রাধান্য দেয়, যা নতুন করে ট্রমা এবং সহিংসতার চক্র তৈরি করে। এটি কেবল অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিবারেই নয়, বিচারক, জুরি এবং জল্লাদদের মতো বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের ওপরও নৈতিক ও মানসিক চাপ ফেলে।
প্রতিশোধ বনাম ন্যায়বিচার: মৃত্যুদণ্ডের বিধানের বিরোধীরা মনে করেন, মৃত্যুদণ্ড ন্যায়বিচারের আধুনিক লক্ষ্য—যা জবাবদিহি এবং ভবিষ্যৎ অপরাধ প্রতিরোধের ওপর জোর দেয়—তার বদলে ‘চোখের বদলে চোখ’-এর মতো প্রাচীন প্রতিশোধের ধারণাকেই অগ্রাধিকার দেয়।
মানবাধিকারের মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ আইনত বা কার্যত মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুদণ্ড বিতর্ক এখন কেবল আইনি তত্ত্বে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি সক্রিয় জননীতি আলোচনায় পরিণত হয়েছে, যার মূল প্রশ্ন হলো: একটি আধুনিক সমাজ কি এমন একটি শাস্তির নৈতিক ও আর্থিক মূল্য বহন করতে পারে যা অপরিবর্তনীয়, বৈষম্যমূলক এবং অপরাধ দমনে অকার্যকর?
দীর্ঘদিন মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তির নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার ঘটনাগুলো ক্রমাগত বিচার ব্যবস্থার ত্রুটি স্মরণ করিয়ে দেয়। ফলে এসব দৃষ্টান্ত সেই অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে যে, যেখানে মানুষের জীবনের প্রশ্ন, সেখানে ভুলের ঝুঁকি নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
মৃত্যুদণ্ডের বিধান বাতিল করেছে যেসব দেশ:
১৯৭৬ সাল থেকে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করা দেশগুলোর তালিকা বাতিলের বছর এবং ধরন অনুযায়ী নিচে দেওয়া হলো:
১৯৭৬: পর্তুগাল (সমস্ত অপরাধ)
১৯৭৮: ডেনমার্ক (সমস্ত অপরাধ)
১৯৭৯: লুক্সেমবার্গ, নিকারাগুয়া, নরওয়ে (সমস্ত অপরাধ); ব্রাজিল, ফিজি, পেরু (সাধারণ অপরাধ)
১৯৮১: ফ্রান্স, কেপ ভার্দে (সমস্ত অপরাধ)
১৯৮২: নেদারল্যান্ডস (সমস্ত অপরাধ)
১৯৮৩: সাইপ্রাস, এল সালভাদর (সাধারণ অপরাধ)
১৯৮৪: আর্জেন্টিনা (সাধারণ অপরাধ)
১৯৮৫: অস্ট্রেলিয়া (সমস্ত অপরাধ)
১৯৮৭: হাইতি, লিকটেনস্টেইন, জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (সমস্ত অপরাধ)
১৯৮৯: কম্বোডিয়া, নিউজিল্যান্ড, রোমানিয়া, স্লোভেনিয়া (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯০: অ্যান্ডোরা, ক্রোয়েশিয়া, চেক অ্যান্ড স্লোভাক ফেডারেল রিপাবলিক, হাঙ্গেরি, আয়ারল্যান্ড, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, সাও টোমে ও প্রিন্সিপে (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯২: অ্যাঙ্গোলা, প্যারাগুয়ে, সুইজারল্যান্ড (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯৩: গিনি-বিসাউ, হংকং, সেশেলস (সমস্ত অপরাধ); গ্রিস (সাধারণ অপরাধ)
১৯৯৪: ইতালি (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯৫: জিবুতি, মরিশাস, মলডোভা, স্পেন (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯৬: বেলজিয়াম (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯৭: জর্জিয়া, নেপাল, পোল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা (সমস্ত অপরাধ); বলিভিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা (সাধারণ অপরাধ)
১৯৯৮: আজারবাইজান, বুলগেরিয়া, কানাডা, এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া, যুক্তরাজ্য (সমস্ত অপরাধ)
১৯৯৯: ইস্ট তিমুর, তুর্কমেনিস্তান, ইউক্রেন (সমস্ত অপরাধ); লাটভিয়া (সাধারণ অপরাধ)
২০০০: কোট ডি’আইভরি, মাল্টা (সমস্ত অপরাধ); আলবেনিয়া (সাধারণ অপরাধ)
২০০১: বসনিয়া-হার্জেগোভিনা (সমস্ত অপরাধ); চিলি (সাধারণ অপরাধ)
২০০২: ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া (বর্তমানে সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো), সাইপ্রাস (সমস্ত অপরাধ); তুরস্ক (সাধারণ অপরাধ)
২০০৩: আর্মেনিয়া (সাধারণ অপরাধ)
২০০৪: ভুটান, সামোয়া, সেনেগাল, তুরস্ক (সমস্ত অপরাধ)
২০০৫: লাইবেরিয়া, মেক্সিকো (সমস্ত অপরাধ)
২০০৬: ফিলিপাইন (সমস্ত অপরাধ)
২০০৭: আলবেনিয়া, রুয়ান্ডা (সমস্ত অপরাধ); কিরগিজস্তান (সাধারণ অপরাধ)
২০০৮: উজবেকিস্তান, চিলি, আর্জেন্টিনা (সমস্ত অপরাধ)
২০০৯: বুরুন্ডি, টোগো (সমস্ত অপরাধ)
২০১০: গ্যাবন (আইন থেকে মৃত্যুদণ্ড অপসারণ)
২০১২: লাটভিয়া (সমস্ত অপরাধ)
২০১৩: বলিভিয়া (সমস্ত অপরাধ)
২০১৫: কঙ্গো (প্রজাতন্ত্র), ফিজি, মাদাগাস্কার, সুরিনাম (সমস্ত অপরাধ)
২০১৬: বেনিন, নাউরু (সমস্ত অপরাধ); গিনি (সাধারণ অপরাধ)
২০১৭: গিনি (সমস্ত অপরাধ)
২০১৮: বুর্কিনা ফাসো (সমস্ত অপরাধ)
২০২০: চাদ (সমস্ত অপরাধ)
২০২১: কাজাখস্তান, সিয়েরা লিওন (সমস্ত অপরাধ)
২০২২: পাপুয়া নিউ গিনি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, নিরক্ষীয় গিনি, জাম্বিয়া (সমস্ত অপরাধ)
২০২৪: জিম্বাবুয়ে (সাধারণ অপরাধ)
তথ্যসূত্র: ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টার