করোনা মহামারি সবকিছু থমকে দিয়েছে। এই কথাটি এতবার এতভাবে বলা হয়েছে ও হচ্ছে যে, তা এখন আর তেমন ঝাঁকুনি দেয় না। তারপরও কথাটি উচ্চারণ করতে হয়। করোনা অর্থনীতির প্রতিটি খাতে ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বলা যায় পর্যটন ও বিনোদন খাতকে। উৎপাদন খাত যেকোনোভাবে নিজের চলমানতা বজায় রাখতে পেরেছে। কিন্তু সংক্রমণ রোধে পর্যটন বন্ধ ছাড়া কোনো কোনো দেশেরই কোনো গত্যন্তর ছিল না। ঠিক একই রকম ধকল গেছে ও যাচ্ছে বিনোদন জগতের ওপর দিয়ে। বিশেষত সিনেমা শিল্প এই করোনাকালে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সিনেমা জগতের দিকে তাকিয়ে অবশ্য বিষয়টি সেভাবে বোঝা যাবে না। কারণ, এই দেশে সিনেমায় মন্দা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। তারপরও করোনার প্রথম ধাক্কা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বিশেষত সিনেমা শিল্পী ও কলাকুশলীদের নানা দুর্দশার গল্প সামনে আসছে। এ গল্প যেন শেষ হওয়ার নয়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা এমন হলেও এই একই রকম ধাক্কা থেকে ঠিকই উঠে দাঁড়িয়েছে হলিউড। আবার জেগে উঠেছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সিনেমা হলগুলো। এখনো যথেষ্ট ঝুঁকি থাকলেও সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘আ কোয়ায়েট প্লেস টু’ ও ‘ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস নাইন’ মানুষকে ঠিকই হলমুখী করতে পেরেছে। আর এর মধ্য দিয়ে আবার জেগে উঠেছে হলিউড। বলিউডও জাগছে ধীরে। মাত্রই করোনার বড় ধকল সামলেছে ভারত। দেশটিতে এখনো করোনা সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাবে না। তারপরও একটু একটু করে খুলছে সিনেমা হলের দরজা। দ্রুতই সেখানে মুক্তি পাবে বড় বাজেটের বেশ কিছু ছবি।
কিন্তু করোনা মহামারির শুরুর ধাপে এই ঘুরে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করেছিলেন বিশ্লেষকেরা। যখন একের পর এক দেশে লকডাউন আরোপ হলো, তখন সাংবাদিকসহ খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা বলেছিলেন, এক নতুন যুগের দিকে যাচ্ছে সিনেমা শিল্প। এমন না ভাবার অবশ্য কোনো কারণই ছিল না। কারণ, তত দিনে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এক ভয়াবহ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। এটা সত্য যে, করোনার এই দুঃসময়ে বহু সিনেমা নিজের মুক্তির পথ খুঁজে নিয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মেই। কিন্তু এতে সিনেমা চললেও বিনিয়োগকারীদের অর্থ উঠে আসেনি অনেক ক্ষেত্রেই। সবচেয়ে বড় মার খেয়েছে সিনেমা হল মালিক বা প্রদর্শক ও পরিবেশক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে করোনার টিকা কার্যক্রম বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে ভালো। অনেকেই টিকা নিয়েছেন এর মধ্যে। ফলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে সবকিছু। তবে এই স্বাভাবিক হওয়ার গতির ওপরও কিন্তু নির্ভর করছে অনেক কিছু। এএমসির কর্মকর্তারা যেমন বলছেন, এই বছরের তৃতীয় প্রান্তিকের (জুলাই–সেপ্টেম্বর) মধ্যে সিনেমা হলগুলোতে দর্শক সংখ্যা যদি কোভিড–পূর্ববর্তীর সংখ্যা ৬৫ শতাংশে এবং চতুর্থ প্রান্তিকে ৯০ শতাংশে পৌঁছাতে না পারে, তবে সংকট জটিল হবে।
আশার কথা হলো এএমসি, সিনেওয়ার্ল্ডসহ বড় বড় চেইনগুলোর মালিকানাধীন সিনেমা হলগুলোতে দর্শক ফিরতে শুরু করেছে এরই মধ্যে। ইউরোপের দেশগুলোতে করোনার টিকা ব্যাপকভাবে দেওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণ রোধে আরোপিত বিধিনিষেধ অনেকটাই শিথিল হয়েছে। সিনেমাবিষয়ক ওয়েবসাইট স্ক্রিনপ্লের তথ্যমতে, চীনসহ বিশ্বের বহু দেশ এরই মধ্যে সিনেমা হলের দরজা খুলে দিয়েছে। গত বছরের মে মাসে পুরো উত্তর আমেরিকার দেশগুলোর মাত্র ২১১টি সিনেমা হল খোলা ছিল, যা করোনা–পূর্ব সময়ের মাত্র ৩ শতাংশ। কিন্তু এ বছরের মে–জুনেই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মোট সিনেমা হলের ৮০ শতাংশের বেশি দর্শকদের জন্য নিজেদের দরজা উন্মুক্ত করেছে।
এই মুহূর্তে সিনেমার জন্য চীনের বাজারই সবচেয়ে বড়। কারণ, করোনার ধকল কাটিয়ে এই দেশই প্রথম সবকিছু খুলে দেয়। গত বছরের জুলাই মাসেই তারা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে চীনা নববর্ষ উদ্যাপনের সময় দেশটিতে ১৫০ কোটি ডলারের সিনেমার টিকিট বিক্রি হয়েছে বলে জানাচ্ছে ইকোনমিস্ট। এই বছর এমনকি সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সিনেমার টিকিট বিক্রি হয়েছে চীনে।
এর কারণও আছে। করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকার পর মানুষ তার স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা উদ্যাপন করতে চেয়েছে। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রে যখন কিছু স্বাস্থ্য বিধি শিথিল করা হয়েছে, তখন সমুদ্র সৈকতগুলোয় ভিড় বেড়েছে। একই ঘটনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য। প্রথম ধাক্কা পেরোনোর পর ধীরে ধীরে বিধিনিষেধ শিথিল করার পর মানুষকে ছুটতে দেখা গেছে কক্সবাজারের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোর দিকে। মানুষ পরিবার–পরিজন, বন্ধু এমনকি অচেনা মানুষের সঙ্গেও মন খুলে আগের মতো মিশতে চেয়েছে। গণপরিবহন চালুর পর একটু বেশিই যেন ভিড় হয়েছে। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। যেকোনো দুর্যোগ পেরোনোর পর দুর্যোগকালে থাকা সীমাবদ্ধতাকে ডিঙিয়ে মানুষ উদ্যাপনে মাতে।
বাংলাদেশের সিনেমাজগতের প্রস্তুতিটি কেমন? হ্যাঁ মুক্তির অপেক্ষায় আছে ‘অন্তরাত্মা’, ‘লিডার’, ‘ঘর ভাঙা সংসার’–এর মতো বেশ কিছু সিনেমা। হলেই এসব সিনেমা মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। থেমে নেই সিনেমা নির্মাণকাজও। প্রশ্ন হচ্ছে কোভিড–পরবর্তী সময়ে যখন সিনেমা হলগুলো খুলবে, তখন দীর্ঘদিন জড়সড় হয়ে বাঁচা মানুষগুলোর হঠাৎ জেগে ওঠা ও বিনোদন জগতে এই জেগে ওঠাকে টেনে আনা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা আছে কি? সাদা চোখে অন্তত তেমনটি চোখে পড়ছে না। করোনার মতো দীর্ঘ দুর্যোগ কেটে গেলে ঘরবন্দী মানুষ খোলা হাওয়ায় একটু শ্বাস নিতে চাইবে। সেই মুহূর্তটিতে আমাদের সিনেমা তার সঙ্গী হতে পারে। আর এই সঙ্গী হতে পারা না পারার বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে সঠিক পরিকল্পনা এবং অতি অবশ্যই ভালো কনটেন্টের ওপর। এই সময়ে পরপর কিছু ভালো সিনেমা পারে দর্শকদের আবার হলমুখী করতে।
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা এবং চীনের দৃশ্যপট অন্তত আমাদের সে কথাই বলছে। তবে এই পরিকল্পনা শুধু সিনেমার নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের করলেই হবে না। এর সঙ্গে যুক্ত করা দরকার হলমালিক থেকে শুরু করে সিনেমার পরিবেশক, প্রচার প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি অংশকে। বলা যায় না, করোনার কারণে হওয়া এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতিই নিয়ে আসতে পারে সিনেমার সুদিন।