হোম > বিশ্লেষণ

রাশিয়ার ইউরেনিয়াম কিনছে চীন, ফের পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার শঙ্কা

গত ডিসেম্বরে চীনা ও মার্কিন কূটনীতিকেরা সামরিক উত্তেজনা কমাতে গঠনমূলক আলোচনা করার অঙ্গীকার নিয়ে আলাপ করছিলেন। আর একই দিন রাশিয়ার প্রকৌশলীরা তাইওয়ানের উত্তর উপকূল থেকে মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে চীন নিয়ন্ত্রিত একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহের কাজ করছিলেন। 

চাংবিয়াও দ্বীপে চীনের তথাকথিত ফাস্ট-ব্রিডার চুল্লি বিশ্বের সবচেয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর একটি। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পূর্বাভাস দিয়েছেন যে, এ বছর এটি কাজ শুরু করলে, সিএফআর–৬০০ নামের স্থাপনাটি পারমাণবিক অস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করবে। এটি বেইজিংকে তার পরমাণু অস্ত্রের (ওয়্যারহেড) মজুত আগামী ১২ বছরে চারগুণ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করতে পারে। এর ফলে চীন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মোতায়েন করা পারমাণবিক অস্ত্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম হবে। 

জাতিসংঘের জেনেভাভিত্তিক নিরস্ত্রীকরণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্লেষক পাভেল পদভিগ বলেছেন, ‘সম্ভবত এই ফাস্ট-ব্রিডার প্রকল্পটি সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক। তবে একটি বিষয়ে আমি ভয় পাচ্ছি, তা হলো, চীন তার বেসামরিক এবং পৃথক প্লুটোনিয়াম মজুতের প্রতিবেদন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। চীনের এমন কর্মকাণ্ড ভালো লক্ষণ নয়।’ 

ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা যখন চরমে তখন চীনের পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণের ক্ষমতা বৃদ্ধির সক্ষমতার বিষয়টি সামনে এল। আর এখন রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত কৌশলগতভাবে সীমিত করার অবশিষ্ট চুক্তিটি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। গত মাসেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন। যেটিকে ‘বড় ভুল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। 

গত ৩০ ডিসেম্বর এক ভিডিও কনফারেন্সে পুতিন চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে বলেছিলেন, প্রতিরক্ষা এবং সামরিক প্রযুক্তি সহযোগিতা দুই দেশের সম্পর্কের ‘একটি বিশেষ স্থানে’ রয়েছে। 

জার্মানির অস্ত্র–নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ হান্না নত্তি বলেন, ‘পরিষ্কারভাবে রাশিয়ার সমর্থনে চীন সুবিধা পাচ্ছে। বেইজিংয়ের জন্য ঝুঁকি হলো, তাদের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পাশাপাশি ক্রেমলিনের অস্ত্র-নিয়ন্ত্রণ চুক্তি বাতিলের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব মজুত বাড়াতে পারে। এতে উত্তেজনা আরও বাড়বে।’ 

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তারা কংগ্রেসে ২০২১ সালে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর চীনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিষয়ে বারবার সতর্ক করে আসছে। সামরিক পরিকল্পনাবিদদের মতে, সিএফআর–৬০০ পরমাণু স্থাপনাটি ২০৩৫ সালের মধ্যে পরমাণু অস্ত্রের মজুত বর্তমান ৪০০ (আনুমানিক) থেকে দেড় হাজারে উন্নীত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রোসাতম গত ১২ ডিসেম্বর প্রায় ৬ হাজার ৪৪৭ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম সরবরাহ করেছে। যা চীনের পারমাণবিক কর্মসূচির পালে হাওয়া দিচ্ছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, চীনের কাছে রাশিয়ার ইউরেনিয়াম সরবরাহ এশিয়ার সামরিক ভারসাম্যকে অস্থিতিশীল করতে পারে। এমনিতেই এ অঞ্চলে তাইওয়ান এবং দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা রয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৯০-এর দশকে চীনের পারমাণবিক অস্ত্রের মূল উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্লুটোনিয়াম মজুত বাড়াতে অন্য পথে হাঁটে বেইজিং। 

তবে পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধকরণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করেছে চীন। বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চীন তার পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের দায়বদ্ধতা কঠোরভাবে পালন করেছে এবং স্বেচ্ছায় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কাছে ‘বেসামরিক পারমাণবিক কার্যক্রমের অংশ’–এর প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। 

চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তান কেফেই গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজস্ব কৌশলগত অস্ত্রাগার সম্প্রসারণের একটি অজুহাত হিসেবে ‘চীনের পারমাণবিক হুমকি’র কথা বারবার প্রচার করছে। চীন এমন একটি প্রতিরক্ষামূলক নীতি বজায় রেখে চলছে যার মধ্যে শুরুতেই পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার নেই। 

মজার বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভ চীন ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার করপোরেশনকে সিএফআর–৬০০ চুল্লির জন্য রোসাতম থেকে জ্বালানি সরবরাহ করতে নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। এই স্থাপনাটি রাশিয়ার নকশা করা। এখানে কার্যক্রম সহনীয় রাখতে পানির বদলে তরল ধাতু ব্যবহার করা হচ্ছে। 

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট নামে লন্ডনের একটি থিংক ট্যাংক এই গোপন লেনদেনের বিশদ একটি বিবরণ সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে সরবরাহ করেছে। 
 
পারমাণবিক শক্তি নিয়ে রাশিয়া এবং চীনের মধ্যকার এই ক্রমবর্ধমান অংশীদারত্ব পরমাণু অস্ত্র সম্প্রসারণ বন্ধ প্রচেষ্টায় বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। থিংক ট্যাংকটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বরের মধ্যে রাশিয়া চীনের সিএফআর–৬০০ স্থাপনার জন্য যে পরিমাণ উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রপ্তানি করেছে, তা গত তিন দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সমঝোতার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এ সংক্রান্ত কাঁচামাল সরিয়ে ফেলা হয়েছে তার সাত গুন। 

এতে দেখা যায়, সিএফআর–৬০০–এর জ্বালানির জন্য চীন সেই সময়ের মধ্যে রোসাতম থেকে ২৫ হাজার কিলোগ্রাম তিন কিস্তিতে প্রায় ৩৮ কোটি ৪০ লাখ ডলার দিয়েছে। তৃতীয় পক্ষের বাণিজ্যিক সরবরাহকারীর কাছ থেকে পাওয়া এবং রাশিয়ান কাস্টমস রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে এ প্রতিবেদন দিয়েছে লন্ডনের ওই থিংক ট্যাংক। 

এই লেনদেনের বিষয়ে রোসাতম মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে রোসাতম–এর টিভিইএল জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের এক বিবৃতিতে বলা হয়, চীনের এই প্রকল্পটি ‘রাশিয়ার বাইরে একটি উচ্চ-ক্ষমতার চুল্লি প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরিণত হবে।’ গত ২৮ ডিসেম্বরের ওই বিবৃতিতে লেনদেনের কথা উল্লেখ না থাকলেও জ্বালানি সরবরাহের তথ্যটি নিশ্চিত করা হয়েছে। 

সিএফআর–৬০০ হলো চীনের উচ্চাভিলাষী ৪৪ হাজার কোটি ডলারের প্রকল্পের অংশ। আগামী দশকের মাঝামাঝি নাগাদ বিশ্বের শীর্ষ পরমাণু-শক্তি সরবরাহকারী দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় এই প্রকল্প হাতে নিয়েছে চীন। 

এই ধরনের রিঅ্যাক্টর গতানুগতিক লাইট–ওয়াটার রিঅ্যাক্টরের মতো নয়। এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এবং তথাকথিত মিশ্র-অক্সাইড জ্বালানির সংমিশ্রণে চলে। উপজাত হিসেবে পাওয়া যায় অস্ত্রে ব্যবহারযোগ্য প্লুটোনিয়াম। 

চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের প্রতিবেশী শহর ল্যাংফাংয়ে গত ডিসেম্বরে শীর্ষ পর্যায়ে কূটনৈতিক বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টা। ওই বৈঠকের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রথম সরকারি সফরের পথ প্রশস্ত করা। যদিও বেলুনকাণ্ডে ব্লিঙ্কেনের চীন সফরটি বাতিল করা হয়। 

ওই বেলুনকাণ্ডের পর দুই দেশের উত্তেজনা আবারও চরমে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ায় মিউনিখে এক নিরাপত্তা সম্মেলনে, চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই মার্কিন প্রতিক্রিয়াকে ‘উসকানি মূলক’ হিসেবে আখ্যা দেন। একই সময় ব্লিঙ্কেন বেইজিংকে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ না করার জন্য সতর্ক করেছিলেন। 

আলেক্সি আরবাতভ নামে এক রুশ অস্ত্র বিশেষজ্ঞ বলেন, আগে চীন নিজেকে ‘ন্যূনতম পারমাণবিক প্রতিরোধের’ জায়গায় সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু এখন স্পষ্টতই চীনারা পারমাণবিক শক্তির মাত্রা এবং গুণমানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে নজিরবিহীন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে রাশিয়া ক্রমশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। অবশ্য এমনকি ইউক্রেন যুদ্ধে বেইজিং নিজেকে নিরপেক্ষ হিসেবে চিত্রিত করার আপ্রাণ চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। 

 ১৯৭০ সালের পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির অধীনে পারমাণবিক অস্ত্র সমৃদ্ধ পাঁচ সদস্যের ক্লাবের মধ্যে চীন এবং রাশিয়া এমন বিশদ প্রতিবেদন দিতে বাধ্য নয়, যার মাধ্যমে বেইজিংয়ের অস্ত্রের মজুত বাড়ানোর জন্য সিএফআর–৬০০ ব্যবহার করা হচ্ছে কি না তা যাচাই করার কাজে লাগে। 

পরমাণু প্রযুক্তি ও জ্বালানির উৎস খুঁজে পাওয়া চীনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বেইজিংকে প্লুটোনিয়াম সরবরাহ করার মতো তেমন কেউ নেই। আর তাদের সরবরাহকৃত ভারী ধাতু চীন যদি অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করে তাতে রাশিয়া আপত্তি করবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী করাটা নিজেদের লাভ হিসেবেই দেখবে রাশিয়া। এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনোভাবেই ভালো সংবাদ নয়। 

জাপান টাইমস অবলম্বনে অনুবাদ করেছেন রাকিব হাসান

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

কোন দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বাধিক, বাংলাদেশের চিত্র কেমন

যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা দক্ষ ইতালির জঙ্গি বিমান ইউরোফাইটার টাইফুন

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত থামেনি, ট্রাম্প ‘থামিয়েছেন’ দাবি করা অন্য যুদ্ধগুলোর কী অবস্থা

তুরস্কের গোয়েন্দা সহায়তায় যেভাবে ‘দামেস্কের আমির’ হলেন আল–শারা