ফরাসি লেখক শার্লে মোরাস নিজের রাজনৈতিক ধারণাগুচ্ছ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন ১৯৩৭ সালে। সে বইয়ে জাতীয়তাবাদকে তিনি সব ধরনের শত্রুর বিরুদ্ধে ‘রক্ষাকবচ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, জাতীয়তাবাদ শুধু বাইরের শত্রু নয়, ভেতরে থাকা শত্রুকে প্রতিহতেও রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। তিনি এই ধারণা প্রচার করেছিলেন ইহুদিবিরোধী অবস্থান থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই ধারণার ধার কিছুটা কমে আসে। কিন্তু হালে এই ফ্রান্সেই আবার একই ধারণা বেশ প্রচার পাচ্ছে।
আজকের ফ্রান্সে নতুন করে কট্টর জাতীয়তাবাদী ধারণা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায়, হঠাৎ করেই দেশটিতে প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের বইয়ের প্রকাশ ও পুনঃপ্রকাশ বেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এ তালিকায় আছে শার্লে মোরাসের সেই বইও। ২০১৮ সালে প্যারিসের অন্যতম প্রভাবশালী প্রকাশক রবার্ট লাফোঁ বইটি পুনঃপ্রকাশ করেন। আর এ বছর ফ্রান্সের ডানপন্থী আরেক প্রকাশনা সংস্থা পুনঃপ্রকাশ করেছে ২০১১ সালে প্রকাশিত বই ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’। বইটির লেখক রনো কামু একজন কট্টর ডানপন্থী লেখক হিসেবে পরিচিত, যিনি বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা বর্ণবাদের অভিযোগ নিয়ে লড়ছেন।
রনো কামু আসলে কী বলছেন? তাঁর ‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ বইয়ের মূল ভাষ্যই-বা কী? তেমন কিছু না। যেমনটা কিছু মার্কিন বলে থাকেন, ঠিক তেমনি কামু বলছেন—ফ্রান্সের জনমিতি অন্যদের দ্বারা বদলে যাচ্ছে। এই অন্যরা কারা? উত্তরটি বেশ মজার। ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশগুলো থেকে আসা লোকেরাই নাকি ফরাসিদের হটিয়ে ফ্রান্সের জনমিতি বদলে দিচ্ছে।
এই ধারণা কিন্তু ফ্রান্সে নতুন নয়। এর আগেও এ ধরনের ধারণা ছড়িয়েছিল দেশটিতে। বিশেষত কট্টর ক্যাথলিক ও ডানপন্থীদের মধ্যে এই ধারণা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু তা সময়ের সঙ্গে স্তিমিত হয়ে যায়। দেশটির মূলধারার রাজনীতিতে এটি প্রায় উহ্য ছিল। কিন্তু এখন আবার ফিরে এসেছে। শুধু ফিরেই আসেনি, বেশ পোক্ত হয়ে এসেছে, যাকে ঠিক সেভাবে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে না। এমনকি নরম গলায় এর সমালোচনাও করা হচ্ছে না।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে ক্রমেই ভ্যালেরাস অ্যাকচুয়েলস ম্যাগাজিন ও সি-নিউজের প্রভাব বাড়ছে। এর মধ্যে সি-নিউজের সঙ্গে আবার সম্পর্ক রয়েছে মার্কিন ফক্স নিউজের। অনেক দিন ব্রাত্য থাকার পর ফরাসি টিভি শোগুলোর অতিথির চেয়ার আবার অলংকৃত করতে শুরু করেছেন রনো কামু। ‘বহিরাগতদের’ দ্বারা ফরাসি জনমিতি বদলে যাওয়ার ভয় বেশ ভালোই দেখাচ্ছেন তিনি। সঙ্গে জোড় বেঁধেছেন এরিক জেমু, যিনি আবার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এরিক জেমু মারি লো পেনের দল ন্যাশনাল র্যালিতেই ছিলেন আগে। গত নভেম্বরে তিনি নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। এটিকে ঠিক কট্টর ডানের ভাঙন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, এরিক জেমুর সঙ্গী হয়েছেন অনেকেই। এর সঙ্গে অভিবাসনবিরোধী অবস্থানের জনপ্রিয়তার পালে লাগা জোর হাওয়ার কথাকেও বিবেচনায় নিতে হবে।
মূলত অভিবাসনবিরোধী অবস্থানই ক্রমে শক্তি পেয়ে আজকের এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে, যেখানে গত শতকেই বাতিল কিছু ধারণা আবার হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ফিরে আসছে। এক ধরনের বর্ণবাদী ধারণা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। এদিকে সবচেয়ে কম বয়সে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হওয়া ইমানুয়েল মাখোঁর ব্যর্থতা তো আছেই। যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার তেমন কিছুই পূরণ করতে পারেননি তিনি। কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সূচকেই পিছিয়ে গেছে ফ্রান্স। এ অবস্থায় জনপ্রিয় মতের সঙ্গে থাকতে গিয়ে মাখোঁও কট্টর জাতীয়তাবাদী ধারণায় হাওয়া দিয়েছেন। মাঝখানে বাম ধারা দুর্বল হয়েছে, মধ্যপন্থীদের ভাঙন এতটাই বেড়েছে যে, তারা নিজেদের শক্তি খুঁজতে এখন পরের দিকে তাকিয়ে থাকছে।
বর্তমান এই পরিস্থিতি অনেকটা পুরোনো বর্ণবাদী মতের কথাই মনে করিয়ে দেয়। শিল্প-সাহিত্যের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত প্যারিসেই ১৮৯৯ সালে শুরু হয়েছিল ‘আসল ফ্রান্স’ আন্দোলনের, যার তাত্ত্বিক ভিতটি গড়ে দেন শার্লে মোরাস। আজকের ফ্রান্সে এই মোরাস আবার ফিরে এসেছেন। শুধু তাঁর বই নিয়ে নয়, প্রভাবশালী অনুসারীদের ঘাড়ে চড়ে। ‘আসল ফ্রান্স’ যেমন কোনো তাত্ত্বিক আন্দোলন ছিল না শুধু, তেমনি ‘ফ্রান্স গেল’ রবটিও অহেতুক নয়। দুটিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই হাজির হয়েছে।
গোটা ইউরোপে কট্টর জাতীয়তাবাদী ধারণা ক্রমে বেড়ে উঠতে থাকলেও সোজাসাপটা এমন অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা এসেছিল আটলান্টিকের ওপার থেকেই। মার্কিন মুলুকে যখন এমন রব ওঠালেন ট্রাম্প, আর তাঁর পেছনে দলে দলে এসে লোক জড়ো হলো, তখন ইউরোপও আর ঘোমটার আড়ালে থাকতে চায়নি। শুধু ইউরোপ কেন, এমন নেতার আবির্ভাব এর পর নিয়মিত বিরতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দেখা গেছে, এখনো যাচ্ছে।
এই কট্টর জাতীয়তাবাদী ধারণার মূল ভিতটি বরাবরই তৈরি করা হয় ‘পরিচয় সংকটের’ প্রশ্নটিকে সামনে হাজির করে। ফ্রান্সে আজ যা তোলা হচ্ছে ‘আসল ফ্রান্স’ হারিয়ে যাচ্ছে বলে, যুক্তরাষ্ট্রে তা-ই উঠেছিল ‘ট্রু আমেরিকান’ প্রশ্নে। এমনকি আজকের এই ইউক্রেন সংকটের সময়ে অভিবাসী স্রোত নিয়ে ইউরোপের যে বর্ণবাদী আচরণ প্রকাশ পেল, তার পেছনেও আছে এই একই প্রশ্ন। পরিচয়; এই এক শব্দ ঘিরেই বারবার কট্টরবাদ মাথা চাড়া দিয়েছে, দিচ্ছে। এটি শুধু যে কোনো একটি মানচিত্র সামনে রেখে তোলা হয়, তা নয়। এই প্রশ্ন ধর্ম, ভাষা, গায়ের রং ইত্যাদি নানা ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে তোলা হয় এবং হচ্ছে।
ফ্রান্সে এখন এই প্রতিটি উপসর্গ বেশ প্রকট। দেশটিতে শেষ পর্যন্ত কট্টরবাদ জয়ী হবে কি-না, সে কথা বলবার সময় যদিও আসেনি। তবে এর শক্ত অবস্থান কিন্তু অন্যদের জন্যও দুঃসংবাদ। কারণ, বিশ্ব রাজনীতিতে কোনো ধারার এমন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করে। কট্টরবাদী রাজনীতির ধারাই হলো—তারা বিরোধী শিবিরের হলেও পরস্পরকে পুষ্টি জোগায়।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন: