অস্থির বাজারের সবচেয়ে দুঃসহ ফলাফল খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। খাদ্যের অভাবে যেমন বাঁচা যায় না, তেমনি জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মানুষের চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়, বিশেষ করে শহুরে মানুষদের। কারণ, আয়ের বেশির ভাগই চলে যায় খাওয়া এবং পরিবহনে। এ অবস্থায় জীবন চালিয়ে নিতে গ্রামের মানুষের মতো তারা খাবার উৎপাদন করতে না পারলেও, যেটা করতে পারে তা হলো—দাঙ্গা।
অনেক দেশের সরকার বর্তমান এ দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা করলেও তারা সফল হচ্ছে না। কোভিড–১৯ মহামারিসহ নানা কারণে দেশগুলো আছে আর্থিক সংকটে। বিশ্বের অধিকাংশ দরিদ্র দেশের বৈদেশিক ঋণ তাদের জিডিপির ৭০ শতাংশের কাছাকাছি, যা ক্রমশ বাড়ছে। এসব ঋণের সুদ পরিশোধেই দেশগুলোর মোট আয়ের অধিকাংশ চলে যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে বিশ্বের প্রায় ৪১টি দেশ হয় ‘ঋণ জর্জরিত’, নয়তো ঋণে জর্জরিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে।
শ্রীলঙ্কা এর সর্বশেষ উদাহরণ। দেশটির উত্তেজিত জনতা সরকারি গাড়ি-অফিস-আদালতে অগ্নিসংযোগ করেছে। প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। পেরুতে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের দাবিতে দাঙ্গা চলমান। কর্মসংস্থান বাড়াতে সশস্ত্র বাহিনীতে নিয়োগের নতুন পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে ভারত। পাকিস্তান জনগণকে চা কম খেয়ে টাকা বাঁচাতে বলেছে। মিসরের প্রেসিডেন্ট গাছের পাতা খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। লাওস ঋণ খেলাপি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। কলাম্বিয়ায় কট্টর বামদের বিজয়ের পেছনেও আগের সরকারের জ্বালানি তেল ও খাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়া বড় ভূমিকা রেখেছে।
জর্ডান, মিসর, তুরস্কের মতো আরও বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে এই তালিকায়। এসব দেশের খাদ্য ও জ্বালানি খাত আমদানির ওপর নির্ভরশীল। আশঙ্কার বিষয় হলো—দেশগুলোর নাগরিকদের আয় ভয়াবহভাবে কমছে। বিভিন্ন দেশেই ক্রমে জনজীবনে নাভিশ্বাস ওঠায় জনগণের রাস্তায় নেমে আসার আশঙ্কা বাড়ছে, যা সহিংস রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে সেসব দেশে এমন আশঙ্কা বেশি, যেখানে বেকার ও বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা বেশি।
মূল্যস্ফীতি দুর্নীতি ও ঘুষের পরিমাণ বাড়িয়ে সমাজে অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। স্বাভাবিক আয়ে যখন ব্যয় সংকুলান সম্ভব হয় না, তখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারি, এমনকি সাধারণ মানুষের টাকা লুটে নেয়। এ রকম একটি পরিস্থিতিই আরব বসন্তের সূচনা করেছিল। তিউনিসিয়ার এক হকার পুলিশকে ঘুষ দিতে দিতে সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়ে আগুন দেন। বু-আজিজি নামের সেই তরুণই আদতে আরব বসন্তের প্রথম ফুলটি ফুটিয়েছিলেন, যা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে সবদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
আসন্ন সংকট এড়ানো খুবই কঠিন হবে বলে মনে করছে ইকোনমিস্ট। তবে তারা কিছু উপায়ের কথাও বলেছে। ইকোনমিস্টের ভাষ্যমতে, সংকট মোকাবিলায় খাদ্য উৎপাদন নিরুৎসাহিত করে এমন যেকোনো সিদ্ধান্ত বাতিলের পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে যাত্রা করা যেতে পারে। এ ছাড়া খাদ্যের দাম ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কৃষকদের ফসলের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে। আর যেসব দেশ এরই মধ্যে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে পুনরুদ্ধারে সহায়তা চেয়েছে, তাদের বেলায় আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সতর্ক হতে হবে। সহায়তা না দিলে যেমন জনগণ কষ্ট পাবে, তেমনি যেকোনো ‘সহায়তা’ দেশগুলোর সরকারকে আরও দুর্নীতির দিকে নিয়ে যাবে কি না, তাও বিবেচনায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত হবে প্রয়োজনীয় সংস্কারে দেশগুলোকে বাধ্য করা।